মেজবাহ হোসেন বঙ্গিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্সধর্মী উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬)। অরণ্যে কাপালিক পালিতা নারী ‘কপালকুণ্ডলা’কে ঘিরে এ উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। এ উপন্যাসের চরিত্র ‘কপালকুণ্ডলা’ নবকুমারকে বলেছে, পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ?
পরবর্তী সময়ে কেউ যখন পথ হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, বিশ্লেষকরা এ উক্তি ব্যবহার করেছেন অনেকবার। বাংলাদেশের চলতি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ সংলাপ আসবে বলেই ধারণা। এখনও একটি দলের এত দিনের চলার পথের সঙ্গে আজকের পথের কোনো মিল নেই, পথ গেছে বেঁকে, বদল হয়েছে সঙ্গী, লক্ষ্যভ্রষ্ট চোখে কেবল ক্ষমতার মোহ! এমন কথামালা কোন দলের জন্যই অধিকতর প্রযোজ্য; সাধারণ মানুষও বোধকরি বুঝতে পারেন। ২০০১-০৬ সময়পর্বে সরকারের সফলতার পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য ব্যর্থতা বা সীমাবদ্ধতাও ছিল অনেক। দুর্নীতি বা অব্যবস্থাপনা প্রকৃত অর্থে যতটুকু ছিল, ভারত প্রভাবিত আওয়ামী লীগ ও বামপন্থিদের প্রচারণা ছিল তার বহুগুণ বেশি। আওয়ামী লীগের লাগাতার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আর ভারত নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে এক-এগারোর মধ্য দিয়ে রাজনীতির মাঠে বিএনপি পুরোপুরি কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিএনপির দুর্নীতির প্রচারণা এত বেশি চালানো হয়, যার ফলে জনগণও বেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, যেটা ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভূমিধসভাবে বিজয়ী করে ক্ষমতায় বসানোর ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়নের পথ তৈরি করে দেয়। কিন্তু এত নেতিবাচক প্রচারণা সত্ত্বেও দেশের জনগণ তারেক রহমানের ওপর হওয়া নির্যাতনকে মেনে নিতে পারেনি। কোনো সুনির্দিষ্ট ও সুদৃঢ় ক্রিমিনাল অফেন্স না থাকা সত্ত্বেও শারীরিক নির্যাতন করে তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে ফেলার দৃশ্য সবার হূদয়ে আঁচড় কাটে। এরপর খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে তার বাড়ি থেকে বের করে দেয়া ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের তহবিল পদ্ধতিগত অব্যবস্থাপনার অজুহাতে তাকে কারান্তরীণ করার কোনো ঘটনাকেই দেশের জনগণ সমর্থন তো করেইনি বরং ক্ষুব্ধ হয়েছে। এরপর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপি তেমন কোনো রাজনৈতিক সফলতা দেখাতে না পারলেও জনগণ দলটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে বিএনপির ত্যাগ ও ক্ষতি অনেক তাতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু এ সময় বিএনপি জনগণের যে সমর্থন ও ভালোবাসা পেয়েছে সেটি একটি রাজনৈতিক দলের অনেক বড় অর্জন। কিন্তু জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকা দলটি গণ-অভ্যুত্থানের পর হঠাৎ গণ-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে পথচলা শুরু করেছে বলে রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মত। এমন পরিস্থিতিতে সামনের দিনের রাজনীতির সমীকরণ কেমন হবে তার বিশ্লেষণ দানা বেঁধেছে।
অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদীদের পলায়ন-পরবর্তী অনেকগুলো ভুলের মধ্যে একটি সুদ্ধতম কাজ হচ্ছে বেগম খালেদা জিয়াকে হঠকারী ফরমায়েশি সাজা থেকে পুরোপুরি অব্যাহতি দেয়া। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিবাদের সুবিধাভোগী ছাড়া সকল দলমত ও শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ছিল, সেখানে বিএনপি ও জামায়াতও ছিল। কিন্তু ছাত্ররা নিজেদের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে, মৃত্যু ও পঙ্গুত্ববরণসহ সম্ভাব্য যেকোনো নৃশংস পরিণতি মেনে নিয়ে সেই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে; তাই বেগম জিয়ার মুক্ত জীবনের কৃতিত্ব ছাত্রদেরই। কিন্তু বিএনপি ছাত্রদের সেই কৃতিত্ব প্রদানে কার্পণ্য করছে। আজ দলের নেতাদের দরাজ গলা, তারা একাই একশো। দুঃসময়ের সঙ্গীদের সঙ্গ ছেড়ে গা-ঝাড়া দেওয়ার প্রবণতা। এখন সঙ্গী, সমর্থন, বুদ্ধি বা পরামর্শ কোনো কিছুই তাদের প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন কেবল একটি নির্বাচনের! প্রয়োজন নেই সেনা হত্যার বিচার, প্রয়োজন নেই বিচারের নামে প্রহসনের, প্রয়োজন নেই গুম-খুনের বিচারের, প্রয়োজন নেই পাচার হওয়া টাকা ফেরতের, প্রয়োজন নেই ফ্যাসিবাদ নিষিদ্ধের বা সংবিধান সংশোধনের—প্রয়োজন কেবলই একটি নির্বাচন, তারপর সবকিছু নাকি তারা করবে, ওসব তাদের কাজ!
মজিব আর হাসিনার মনোভাব ছিল যে তারা জীবদ্দশা অব্দি মুক্তিযুদ্ধ আর বাংলাদেশের মালিক। মুক্তিযোদ্ধারা সবাই মজিবের ভাড়াটিয়া (!), যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব, সার্টিফিকেট আর ভাতা দেয়া হয়েছে ব্যস। তাদের আর কোনো দাবি-দাওয়ার সুযোগ নেই, এখন সবকিছু মজিবের তালুক! বিএনপির ক্ষেত্রেও এখন একই মনোভাব দেখা যাচ্ছে—ছাত্ররা জীবন দিয়ে ফ্যাসিবাদ বিদায় করবে, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার শত শত কাজ ফেলে বাংলাদেশে এসে একটা নির্বাচন করিয়ে দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে হবে তারপর সবাই বিদায় নেবে, তালুক চালাবে বিএনপি। মামাবাড়ির আবদারও বোধহয় এত হাস্যকর হয় না। বেগম জিয়া রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়, তারেক রহমানও অনেকটা কূটনীতির ভাষায় বক্তব্য দিচ্ছেন (খোলামেলাভাবে কিছু বলছেন না) কিন্তু ফখরুল সাহেব ও ২-৩ জন প্রবীণ নেতার যেন আর তর সইছে না। আচ্ছা ফখরুল সাহেব কি দেশের প্রধানমন্ত্রী/রাষ্ট্রপতি নাকি আগামী নির্বাচনে দলের প্রধান মুখ যে তিনি বাংলাদেশের মাটি কী কাজে ব্যবহার হবে আর হবে না তার ফরমান জারি করছেন? বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যখন দরবার হলে সেনাদের নির্বিচারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল তখন ফখরুল সাহেব কি ঘুমিয়ে ছিলেন? বিগত ১৬ বছরে ভারতের কাছে থেকে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা তো দূরের কথা, আপনার নেত্রীকে অন্যায়ভাবে কারাগারে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেননি; তাহলে ক্ষমতায় যাবার আগেই কেন ভারত তোষণ। ২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার সময় কোনো কিছুই আপনাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না, সেখানে বর্তমান টালমাটাল পরিবেশে তিন মাস/ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দিলে যে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন তার কি নিশ্চয়তা? সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখনের ক্ষমতা যদি ইউনূস সরকারের না থাকে তাহলে সর্বোচ্চ আদালতের রায় বাতিল করে বেগম জিয়াকে মুক্তি দেওয়াটাও অবৈধ হওয়ার কথা বা অসাংবিধানিক উপায়ে হাসিনা সরকার উৎখাত করাও অবৈধ! নয় কি?
৫ আগস্টের পর বিএনপি-জামায়াত ইস্যুতে অনেকটা আওয়ামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, মানে ‘সাথে থাকলে সঙ্গী, না থাকলে জঙ্গি’। হাসিনার ১৬ বছরে তার সবচেয়ে বড় ব্যর্থ প্রজেক্ট ছিল বিএনপি-জামায়াত জোটকে ভাঙতে না পারা। তাহলে দীর্ঘ আড়াই দশকের জোট সঙ্গী জামায়াত আজ কেন বিএনপির সতীনে পরিণত হলো? কেন বিএনপি নেতারা আওয়ামী লীগের ভাষায় জামায়াতকে একাত্তরের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে উদ্যত, কেন তারা জামায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে? সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, দুর্নীতি, গুম খুনের পাশাপাশি হাসিনার আরও একটি নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্য হলো ‘নীতিহীনতা’। ব্যক্তি হাসিনা আর আওয়ামী লীগ নেত্রী হাসিনা দুটি সত্ত্বাই নীতিহীন চরিত্রের নিবিড় ধারক। ’৮৬-এর নির্বাচন হোক আর ৯১-৯৬ আমলে জামায়াতের পরামর্শে ও তাদের সঙ্গে নিয়ে ১৭৩ দিন হরতাল পালন হোক বা ২০১৪তে সবাইকে নিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার হোক হাসিনা একজন বেইমান, তার নিজের ভাষ্যে ‘জাতীয় বেইমান’। ’৭১-এর ভূমিকার কারণে একই ব্যক্তি (বা দল) ‘৯১ আর ২০০৮-এ কীভাবে দুটি ভিন্ন চরিত্রে হাসিনার কাছে আবির্ভূত হয়? আর জামায়াত যদি প্রকৃত বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয় তবে সেই অপরাধীদের সাথে জোট করার দায়ে আওয়ামী লীগেরও অবশ্যই বিচার হতে হবে। ১৯৯৯ পরবর্তী সুসময় ও দুঃসময়ের এই সঙ্গীর প্রতি বিএনপি যদি আওয়ামী লীগের মতোই দ্বিচারী আচারণ করে তাহলে তার রাজনৈতিক সততা ও অঙ্গীকারও মানুষের কাছে প্রতারণা বলে গণ্য হবে; তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিএনপি আন্দোলন সংগ্রামে দুর্বল হলেও ভোটের মাঠে শক্ত প্রতিপক্ষ এই কথাটা আওয়ামী লীগ জানে ও মানে তাই হাসিনার পাতানো নির্বাচনগুলোর প্রধান লক্ষ্যই থাকত, যাতে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা যায়। ভোটের মাঠে এই বিশাল পুঁজি কি তাহলে বিএনপির একার? না, এই বিশাল ভোটব্যাংকের অনেকগুলো ভাগ আছে, যেমন—জামায়াত ও ইসলামী সমমনা দলের অংশ, ভারত ও আওয়ামী বিরোধী অংশ আর বিএনপির ভেতরে ও বাইরে থাকা কিছু সজ্জন মানুষের অভিহিত মূল্য বা ফেসভ্যালু। এছাড়া হাসিনার ১৬ বছরে অনেক নির্যাতিত সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক বোদ্ধা ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের সহানুভূতি বিএনপি পেয়েছে যাদের অনেকের দেশের মানুষ বিশেষত তরুণদের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করার সক্ষমতা আছে। তাই গণমানুষের প্রত্যাশার বিপরীতে শুধু একটি জাতীয় নির্বাচন চেয়ে সকল মিত্র পক্ষের বিরাগভাজন হয়ে বিএনপি ভোটের মাঠে কতটুকু সফলতা অর্জন করবে তা নিয়ে সন্দেহ থাকে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি ক্ষমতার মসনদে বসলেও সেটি হবে কেবল আওয়ামী লীগের স্থান বদল, কারণ এই বিপুল মিত্র গোষ্ঠী তখন কেবল আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপির বিরোধিতায় লিপ্ত হবে।
বিরোধীদের এই প্রবল চাপ সামলাতে ভারত ও -র আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করলেও বিএনপির হয়ে সেই কাজ করার জন্য কোনো শক্তিশালী পক্ষ অবশিষ্ট থাকবে না। বিএনপিকে অবশ্যই ভাবতে হবে ক্ষমতায় বসে চতুর্মুখী সেই চাপ সামাল দেবার জন্য তাদের কী ব্যবস্থা আছে। তাই দলটির এখন উচিত হবে মিত্রদের আস্থায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করা, নিজেদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে সংগঠনের দুর্বলতা দূর করা ও ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো। অন্যথায় রিভার্স ’৯১ (৯১-এর নির্বাচনে হারতে হারতে জিতে যাওয়ার বিপরীতে জিততে জিততে হেরে যাওয়া) অভিজ্ঞতা তাদের ঝুলিতে যোগ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। হাসিনা দেশের ভেতরে বাইরে সকল গণতান্ত্রিক পক্ষকে ঠাণ্ডা করে রেখে যখন বসন্ত উপভোগে বুঁদ ছিল তখন বাতাসে বিপদের গন্ধ ছড়ানোর আগেই ফিনিক্স পাখির দল তার গদি উল্টে দিয়েছে। ঠিক একইভাবে ঘটনা ঘটে যাওয়ার আগে বিএনপির প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বীকেও হয়তো আমরা কেউই চিনতে পারব না।
শিক্ষক, রসায়ন বিভাগ, হাবিপ্রবি
পিএইচডি ফেলো, কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র