Print Date & Time : 12 September 2025 Friday 12:09 am

সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বালু বিক্রি, হুমকিতে পরিবেশ

রিয়াদুল ইসলাম রিয়াদ, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম): চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় পুঁইছড়ি এলাকার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ছড়া থেকে অবৈধভাবে তোলা হচ্ছে বালু। আর পাহাড়ের পাদদেশে কোটি টাকার এ বালু উত্তোলনের কাজে জড়িয়ে পড়েছে পুঁইছড়ি স্থানীয় প্রভাবশালী এক সিন্ডিকেট। পাহাড়ের পাদদেশে বেয়ে আসা ছড়া হতে বালু উত্তোলনের ফলে একদিকে যেমন বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশ, অন্যদিকে পুরো পাহাড়ধসে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বনভূমি। এরই সঙ্গে বালু পরিবহনে পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণের কারণে পাচার করা হচ্ছে গাছ পালা। নষ্ট করা হচ্ছে সরকারি রাস্তা ঘাট। অন্যদিকে পাহাড়ের পাশের ছড়াগুলোর বালু তুলে পাচার করায় এগুলো বর্তমানে নদীতে রূপ নিচ্ছে। কর্তৃপক্ষ এসব কর্মকাণ্ডে বাধা না দিয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে। মাটি কাটা, গাছ পাচার, পাহাড় ও ছড়া কাটার ক্ষেত্রে কেউই বিধি-বিধানের তোয়াক্কা করছে না। এতে পাহাড় কেটে ছড়া থেকে বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশের ভারসম্য নষ্ট হচ্ছে। বিলীন হয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ পাহাড় ও সবুজ বনভূমি, বর্তমানে এই বনভূমি চুনতি অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দিন দিন মরভূমিতে পরিণত হচ্ছে।

সরেজমিন মঙ্গলবার বিকালে ওইসব স্পট পরিদর্শন কালে দেখা যায়, পুঁইছড়ি ইউপির পূর্ব পুঁইছুড়ি ৫নং ওয়ার্ডে বহরা তলী এলাকায় অর্থাৎ পুঁইছড়ি প্রেমবাজার থেকে পূর্বে তিন কিলোমিটার দূরে এই বালুমহাল। ওই চড়ার অন্তত ৬-৭টি স্পট থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে ড্রেজার মেশিন দিয়ে। প্রেমবাজার থেকে পূর্বদিকে রওনা দিতেই দেখা যায়, পুরো ৩ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা খুবই লাজুক। এই যেন এক বালুর হাটবাজার। প্রতি দশ মিনিটের মাথায় একের পর এক বালুভর্তি ট্রাক আসছে আর যাচ্ছে। রাস্তাজুড়ে ধুলো আর ধুলো।

স্থানীয়রা জানান, জঙ্গল পুঁইছড়ি বালুমহালের ইজারা ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে বাতিল করে জেলা প্রশাসন। এর আগে ২০১৯ সালে স্থানীয় ঠিকাদার মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন ২২ লাখ ৫৩ হাজার টাকায় জঙ্গল পুঁইছড়ি বালুমহাল ইজারা নিয়েছিলেন। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢলে গ্রামের পর গ্রাম তলিয়ে যাওয়ার অভিযোগে বালুমহালের ইজারা বাতিল করে দেয় জেলা প্রশাসন। কিন্তু সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বন্ধ হয়নি বালু উত্তোলন। বরং দিনের পর দিন আরও বেশি করে বালু তুলছেন একটি প্রভাবশালী বালু সিন্ডিকেট। যার ফলে এসব বনভূমি এলাকা থেকে একশ্রেণির স্থানীয় ক্ষতিপয় নেতাকর্মী ও প্রভাবশালী চক্র সিন্ডিকেট গঠন করে প্রতিযোগিতা মূলকভাবে টিলা ও ছড়া কেটে বালু এবং মাটি উত্তোলন করেই যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বনের গাছও সাবাড় করে ফেলছে ভূমিদস্যুরা। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অনুমোদন বিহীন অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে রাস্তা-ঘাট ও শত শত বছরের পাহাড়গুলো ধ্বংস হয়ে বনায়নের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। যেভাবে টিলা, ছড়া, পাহাড় কেটে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তা খুবই বিপর্যয়। এতে প্রাকৃতিক পরিবেশ চরমভাবে হুমকির মুখে পড়বে। পুরো এলাকাজুড়ে ভাঙন রোধে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকায় দিন দিন পাহাড়গুলোর ভাঙন দেখা দিয়েছে। ফলে প্রতি বর্ষা মৌসুমে হাজার হাজার ফসলি জমি, জীব বৈচিত্র্য, বসতভিটা, রাস্তাঘাট, মসজিদ, কবরস্তান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ মূল্যবান জাতীয় সম্পদ বিলীন হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের বিপর্যয় গড়ছে।

স্থানীয়রা আরও জানান, প্রতিদিন তারা ১০০ থেকে ২০০ ট্রাক বালু বিক্রি করেন। ট্রাকযোগে বালুগুলো বিভিন্ন এলাকায় সাপ্লাই দেয়া হয়। প্রতি ট্রাক বালু ২ হাজার ৫০০ টাকা করে। এর বাইরে গাড়ির ভাড়া নির্ধারণ করা হয় স্থান বুঝে। আবার ঘরোয়া ক্রেতারা স্থানভেদে কিনছেন ৪ হাজার থেকে আট হাজার টাকায়। পাহাড়ি এই চড়ার বিভিন্ন স্থানে এখনও মজুত রয়েছে অন্তত ১০-১৫ কোটি টাকার বালু। আর তাতে বালু উত্তোলনের কাজে রয়েছে একটি ১২-১৫ সদস্যের বিশাল সিন্ডিকেট। এদিকে প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট করে অধিক মুনাফার আশায় প্রভাবশালীরা বালু উত্তোলন সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়ছে। এই অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন এলাকাবাসী।

পরিদর্শনকালে বালু মহলের কথিত ম্যানেজার দাবি করা খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রতি ট্রাক বালু ২ হাজার ৫০০ টাকা করে বিক্রি করি। এর বাইরে গাড়ি ভাড়া। সেটা স্থান বুঝে নেওয়া হয়। আপনাদের বালুমহালে কোনো সরকারিভাবে কোনো ইজারা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি ইজারা আছে বলে বলেন! যদি কেউ আটকায় বালুর ট্রাকÑএই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা ইজারাদারের পক্ষ থেকে প্রতি ট্রাকের ড্রাইভারকে একটি টোকেন দিয়ে থাকি। এই টোকেন দেখলে পুলিশ প্রশাসন, বন বিভাগ এবং উপজেলা প্রশাসন কেউ আমাদের গাড়ি আটকাবে না।’

এ বিষয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল খালেক পাটোয়ারী জানান, ‘বাঁশখালীতে বেশ কয়েকটি স্পটে ইজারা যোগ্য বালু মহল আছে, কিন্তু কোথাও কোনো ধরনের বালু মহল ইজারা দেয়া হয়নি। গত বছর ১টি মাত্র ইজার ছিল, সেটিও বাতিল করে দেয়া হয়েছে। সরকারিভাবে কোথাও কোনো বালুমহাল ইজারা দেয়া হয়নি। যদি কেউ অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার বলেন, ‘আমরা এই মুহূর্তে নির্বাচনী কাজ নিয়ে দম ফেলতে পারছি না। তাই অভিযান করতে একটু সময় লাগতেছে। তবে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হলে সেই যেই কেউ হউক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাছাড়া অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের তালিকা প্রণয়ন করে তাদের বিরুদ্ধে খুব শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে।’