Print Date & Time : 27 August 2025 Wednesday 8:20 pm

সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে মানব পাচার রোধ করতে হবে

শাহজাহান কিবরিয়া: মানব পাচার আধুনিক সভ্যতার অন্যতম জঘন্য অপরাধ। মানব পাচারের খবর আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। আসলে মানব পাচার কী আমাদের জানা দরকার। প্রতিবছর প্রচুর মানুষ এই মানব পাচারের শিকার হচ্ছে। আমরা গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি বিদেশ নিয়ে যাওয়ার নাম করে হাজার হাজার মানুষকে পাচার করা হচ্ছে। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন করার জন্য দেশে ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২’ বলবৎ রয়েছে। ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২’-এর ধারা ৩ অনুযায়ী মানব পাচার বলতে বোঝায়, ‘কোনো ব্যক্তিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাহিরে যৌন শোষণ বা নিপীড়ন বা শ্রম শোষণ বা অন্য কোনো শোষণ বা নিপীড়নের উদ্দেশ্যে ক্রয়-বিক্রয়, সংগ্রহ বা গ্রহণ, নির্বাসন বা স্থানান্তর, চালান বা আটক করা বা লুকিয়ে রাখা বা আশ্রয় দেয়া, কাউকে ভয়ভীতি প্রদর্শন বা বলপ্রয়োগ করা, কাউকে প্রতারণা বা আর্থসামাজিক বা পরিবেশগত বা অন্য কোনো অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে অর্থ বা অন্য কোনো সুবিধার মাধ্যমে তার ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, এমন ব্যক্তির সম্মতি গ্রহণ করা।’ এর যে কোনো একটি উপায় হলে সেটাকে মানব পাচার বুঝতে হবে। তবে যদি কোনো শিশু পাচারের শিকার হয়, সেক্ষেত্রে ওপরে বর্ণিত মানব পাচার অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমসমূহ অনুসৃত হয়েছে কি না, তা বিবেচিত হবে না। সুতরাং কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে কোনো শিশুকে তার অভিভাবকের অনুমতি সাপেক্ষে বা অভিভাবকের বিনা অনুমাতিতে স্থানান্তর করলেই মানব পাচার হিসেবে গণ্য হবে।

মানব পাচার হলো এমন একটি উপায় যার মাধ্যমে সব লিঙ্গ, বয়স, বর্ণ ও সংস্কৃতির মানুষকে বিনা মূল্যে শ্রম ও যৌনকর্মের জন্য কেনা-বেচা করা হয়। সহজ করে বললে, এটা একটা দাসত্ব। যারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে তারা হলো নারী, শিশু, কিশোর, গৃহহীন ব্যক্তি, অভিবাসী এবং পালকের যত্নে থাকা শিশু। অনেক সময় মানুষ বুঝতে পারে না যে, তারা মানব পাচারের শিকার। অন্যান্য ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তরা সাহায্য চাইতে পারে না বা সাহায্য চাইতে ভয় পায়। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রতিবছর ৩০ জুলাই বিশ্ব মানব পাচার বিরোধী দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে পালন করার সিদ্ধান্ত হয়। পাচারের শিকার ব্যক্তিদের অধিকারগুলো প্রচার ও সুরক্ষা করাই এই দিবসের লক্ষ্য। তারপরও প্রতিবছর মানব পাচারের হার কমছে না।

এই জঘন্যতম অপরাধটি কোনো একক ব্যক্তির পক্ষে একা করা সম্ভব হয় না। এই অপরাধের পেছনে থাকে বিশাল একটি চক্র। যে যে দেশে মানব পাচার হয়, সেই দেশের দালালদের মধ্যে থাকে যোগসূত্র। দলবদ্ধ পরিকল্পনার মাধ্যমে এই অপরাধটি সংঘটিত হয়। আমাদের দেশে মানব পাচার হয় মৌসুম হিসাব করে। পাচারকারীরা শীতকালকে পাচারের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় বিবেচনা করে, কারণ এই সময় সমুদ্র কিছুটা শান্ত থাকে, তাই তারা ছোটো ছোটো নৌকা করে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে মানব পাচার করে। মানব পাচারের দিক থেকে আন্তর্জাতিক সংস্থার তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে। আর এর প্রধান কারণ হলো বেকারত্ব। দেশের বিপুল পরিমাণ বেকার ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ধারণা, বিদেশে গেলে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে। পারিবারিক সচ্ছলতা আসবে এই বিশ্বাস নিয়ে অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয় তারা। তাদের এই বিশ্বাসকে পুঁজি করে স্বার্থ হাসিল করে পাচারকারীরা। নারীদের ক্ষেত্রেও একইভাবে বিভিন্ন এলাকার তালাকপ্রাপ্ত, অল্পবয়স্ক বিধবা এবং কাজের সন্ধান করছে এমন নারীদের টার্গেট করে পাচারকারীরা। অনেক সময় পাচারকারীরা অপহরণ বা প্রেমের ফাঁদে ফেলে পাচার করে দেশে-বিদেশে। এসব মানুষ পাচারের পাশাপাশি আরও কিছু অপরাধের শিকার হয়। যেমন প্রতারণা, জোরপূর্বক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, জোরপূর্বক যৌনতা, জোরপূর্বক শ্রম, মুক্তিপণ, মাদক পাচার,  প্রভৃতি। মানব পাচারের মাধ্যমে অনেকগুলো অপরাধ একসঙ্গে সংগঠিত হয়।

আমাদের দৈনন্দিন জীবন এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত হয়েছে। মানব পাচারের অপরাধ সাইবার স্পেসকে জয় করেছে। ইন্টারনেট ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো পাচারকারীদের পাচারের যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ, শোষণ এবং পাচারের শিকারদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অসংখ্য সরঞ্জাম (ঞড়ড়ষং) সরবরাহ করে; তাদের পরিবহন ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে; পাচারের শিকার মানুষের বিজ্ঞাপন ও সম্ভাব্য ক্লায়েন্টদের কাছে পৌঁছান; অপরাধীদের নিজেদের মধ্যে নিবিড় নিরাপদ যোগাযোগ ও অপরাধমূলক আয় লুকান এবং এসব কিছু দ্রুত, কম খরচে ও পরিচয় গোপন রাখতে সহায়তা করছে। প্রযুক্তি মানব পাচারে জড়িত অপরাধীদের আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করতে এবং তাদের শনাক্তকরণ এড়াতে অনেক সময় সহায়ক হয়। পাচারকারীরা শিশুসহ নারী ও পুরুষ ভিকটিমদের শনাক্ত করতে, তাদের এজেন্ট নিয়োগ করতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। ই-মেইল এবং মেসেজিং ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে পাচারযোগ্য ব্যক্তিদের প্রলুব্ধ করা এবং সম্ভাব্য এজেন্টদের পাচারযোগ্য ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানতে বিজ্ঞাপন দেয়ার সুবিধা দেয়। এর বিপরীতে সরকারের অ২ও মানব পাচারের বিরূদ্ধে ডিজিটাল সার্পোট দিয়ে থাকে।

মানব পাচার প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহারও দিনদিন বাড়ছে। মানব পাচার নির্মূলে ভবিষ্যৎ সাফল্য নির্ভর করে কীভাবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা এবং অন্যরা তাদের কার্যাবলিতে প্রযুক্তির ব্যবহার করছে তার ওপর। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং অ২ও মানব পাচারকারীদের মোকাবিলায় ব্যবহƒত হটলাইন ৯৯৯-এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের চিহ্নিত ও শনাক্ত করতে প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পাচারকারীদের গতিবিধি নজরদারিতে রাখা, পাচারকারী নেটওয়ার্কের পদ্ধতির ওপর নজর রাখা, পাচারের ঘটনা তদন্তে প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া; ফৌজদারি মামলায় ভিকটিমদের সহায়তা করার জন্য ডিজিটাল প্রমাণের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া বৃদ্ধি করা এবং পাচারের শিকার বেঁচে থাকা উদ্ধারকৃত ব্যক্তিদের সহায়তা পরিষেবা প্রদান করা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মূল লক্ষ্য।

মানব পাচারের আরও একটি কারণ হলো অসচেতনতা। নারী-পুরুষ ও শিশুদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য মানব পাচার বন্ধ করতে হবে এবং এজন্য সমাজের সচেতন মহলকে শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাচার রোধে দেশব্যাপী জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম ও সামাজিক আন্দোলন করা খুবই জরুরি। মানব পাচার প্রতিরোধে জাতীয় ও গ্রাম পর্যায়ে সভা, সমাবেশ, সেমিনার, আলোচনা ও মতবিনিময়ের আয়োজন করতে হবে। এতে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, স্থানীয় নেতা, শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা নিজ নিজ এলাকায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। পাচার হওয়া ভিক্টিম যারা ফিরে আসে, তাদের নিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম বা ভিক্টিমদের বক্তব্য, তাদের দুর্দশার কথাগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের সহজ-সরল মানুষের মাঝে তুলে ধরার মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে। যে এলাকা থেকে মানব পাচার বেশি হচ্ছে, সেই এলাকা চিহ্নিত করে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রচার কার্য অব্যহত রাখতে হবে। বেকারত্ব কমাতে যুবক ও মহিলাদের কারিগরি শিক্ষা বৃদ্ধি করে নিজ দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। জনশক্তি রপ্তানিতে সরকারি কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া উপকূল ও সীমান্ত এলাকাতে পর্যাপ্ত কোস্ট গার্ড ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর সংখ্যা বাড়িয়ে নজরদারি বৃদ্ধি করে মানব পাচার রোধ করার চেষ্টা অব্যহত রাখতে হবে। তাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে হবে। আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করে সমুদ্রসীমা সুরক্ষা এখন সময়ের দাবি। টেকনাফসহ সীমান্ত এলাকাগুলোয় ওয়াচ-টাওয়ার করে মানুষের সার্বক্ষণিক চলাচল পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। এছাড়া জল, স্থল ও আকাশপথে নজরদারি বাড়াতে হবে।

মানব পাচার রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গণমাধ্যম নিয়মিত জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান ও সতর্কতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। কয়েক বছর ধরে গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করছে। মানব পাচারের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে চলচ্চিত্র ও নাটক সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। মানব পাচার জঘন্যতম একটি ব্যবসা। এটি নির্মূলের মাধ্যমে আমরা আধুনিক দাস প্রথা থেকে মুক্তি পেতে পারি।

 

পিআইডি নিবন্ধ