Print Date & Time : 12 September 2025 Friday 3:38 am

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের চেয়ে উত্তোলন বেশি

নিজস্ব প্রতিবেদক: সঞ্চয়পত্রে নানা কড়াকড়ি। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ। ফলে সঞ্চয়পত্রে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে, তার চেয়ে আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের ভাঙানো বাবদ মূল অর্থ পরিশোধের পরিমাণ বেশি হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেও নিট বিনিয়োগ ঋণাত্মক। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে নিট বিনিয়োগ কমেছে তিন হাজার ৫৮০ কোটি টাকা।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, একসময় কোনো স্কিমের মেয়াদ শেষ হলে আবার সেখানেই বিনিয়োগ করতেন বেশিরভাগ গ্রাহক। তবে এখন মেয়াদপূর্তির পর যে হারে সঞ্চয়পত্র ভাঙছে, সেই হারে নতুন বিনিয়োগ করছে না, যার কারণে বিক্রির আয়ের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে এ খাতে ধারাবাহিক বিনিয়োগ কমে বেশ কয়েক মাস ধরে ঋণাত্মক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধি চলছে।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। উল্টো তিন হাজার ৫৭৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা সরকার তার কোষাগার ও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।

গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে। মূল্যস্ফীতি এখন অন্যতম প্রধান সমস্যা উল্লেখ করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, সুদের হার দিয়ে অন্য দেশ মূল্যস্ফীতি কমিয়েছে। আমরা সেই চেষ্টাই করিনি। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য নি¤œমুখী হলেও দেশের বাজারে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। কারণ অভ্যন্তরীণ বাজারে বিশৃঙ্খলা রয়েছে। সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে, এমন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক সাময়িকভাবে কমানো হলে হয়তো স্বস্তি আসবে।

আরেক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) হিসাব অনুযায়ী, মানুষের আয় আগের মতো থাকলেও অনেক বেড়েছে ব্যয়। এমন অবস্থায় খাদ্যাভ্যাস বদল করেছে অনেক মানুষ। কেউ কেউ এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে, নতুন সঞ্চয় থেকে বিমুখ হচ্ছে। ঋণ করেও চলছে অনেকে। আবার দরিদ্রদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ এখন এক বেলা কম খাচ্ছে।

সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি বছরের এপ্রিলে একক মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে পাঁচ হাজার ৩৮১ কোটি টাকার। বিপরীতে ওই মাসে মূল ও মুনাফা বাবদ সরকারকে পরিশোধ করতে হয়েছে চার হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা। এসময় নিট বিক্রির দাঁড়িয়েছে ৫৮১ কোটি ৭৯ লাখ টাকায়। আগের মাস মার্চে নিট বিক্রির ঘাটতি (ঋণাত্মক) ছিল ৬৫২ কোটি টাকা।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা থাকে। সরকার তা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৬৮ হাজার ৩৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে মুনাফা ও মূল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৭১ হাজার ৬১৮ কোটি ৫২

 লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ১০ মাসে যা বিনিয়োগ হয়েছে তার চেয়ে ৩ হাজার ৫৭৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে সরকার। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার কোনো ঋণ পায়নি। বরং আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের নগদায়নের চাপে মূল ও মুনাফাসহ ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে।

এদিকে অতি মাত্রায় সুদ পরিশোধ কমাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নানা শর্ত দেয়া হয়েছে, যার কারণে এ খাতে বিনিয়োগ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে নেমে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে আসছে বাজেটে ঘাটতি পূরণে সরকার সঞ্চয়পত্রের নির্ভরতাও কমিয়ে ফেলছে।

আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা ঠিক করছে সরকার, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ১৭ হাজার কোটি টাকা কম। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্য ঠিক করা আছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।

অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিতে চায় সরকার, যার পরিমাণ এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এর পর সঞ্চয়পত্র থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা আর অন্যান্য খাত থেকে পাঁচ হাজার এক কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।