কাবেরী মৈত্রেয়: মধ্যবিত্ত এই আপনি প্রতি মাসে একটু একটু করে কিছু টাকা সঞ্চয় করেছেন। সেজন্য অবশ্য আপনাকে অনেক শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হয়েছে, ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক পছন্দের খাবার, দেনদরবার চালিয়ে যেতে হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন বাজারের সঙ্গেও। মাসে মাসে যে টাকা সঞ্চয় করছেন, তা বছর শেষে দেখা গেল একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে দাঁড়িয়ে গেছে, যা কোথাও বিনিয়োগ করলে, ভাবছেন, কিছু লভ্যাংশ আসবে ঘরে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আপনার এই অর্থ কোথায় বিনিয়োগ করবেন? সরকারি-বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানই বা আপনার রাখা অর্থের বিপরীতে সর্বোচ্চ মুনাফা দিতে পারবে?
দেশের শেয়ারবাজারের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। বলা যায় তলানিতে। ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসাবে (এফডিআর) টাকা রাখলেও আগের মতো আর সুবিধা মিলবে না। কেননা চলতি বছরের এপ্রিলের মধ্যেই আমানতের সুদহার ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার তোড়জোড় আছে ব্যাংক খাতে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও কো-অপারেটিভ সোসাইটিগুলো একরকম আস্থার সংকটে পড়েছে বেশিরভাগ গ্রাহকের কাছে।
প্রশ্ন হচ্ছে নিম্নমধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ, অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, কিংবা আপনার-আমার মতো সঞ্চয়প্রবণ নারীরা যাবেন কোথায় এখন? লভ্যাংশ হিসাবে বাড়তি টাকা হাতে না এলে ভালোভাবে খেয়ে-পড়ে আপনি আরও একটু ভালো কীভাবে থাকবেন, কীভাবে নিশ্চিন্তে থাকবেন?
এসব প্রশ্ন যাদের, উত্তর হিসাবে নির্দ্বিধায় তাদের জন্য বিনিয়োগের একটি দরজা এখনও খোলা। সেটা হচ্ছে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের অন্যতম উৎস সঞ্চয়পত্র। তবে সঞ্চয়পত্র খাতে বিনিয়োগের আগে গ্রাহকদের জানতে হবেÑদেশে কয় ধরনের সঞ্চয়পত্র আছে, একেকটি সঞ্চয়পত্রের ধরন কী, সুদের হারই বা কত?
সাধারণত দেশে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র ব্যবস্থা চালু আছে। পরিবার সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র। নামের মধ্যেই রয়েছে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র। পরিবার সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র মূলত পাঁচ বছর মেয়াদি। পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদ মাসিক ভিত্তিতে এবং তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের সুদ তিন মাস অন্তরও তোলা যায়। সাধারণত ৫০ হাজার, এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের পেনশনার সঞ্চয়পত্র রয়েছে। আর পরিবার সঞ্চয়পত্র রয়েছে ১০ হাজার থেকে শুরু করে ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের। সঞ্চয়পত্রগুলো পাওয়া যায় সারা দেশের জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের ৭১টি সঞ্চয় ব্যুরো কার্যালয়, সব ডাকঘর, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব কার্যালয়সহ বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে।
যদিও দেশের সব মানুষই এসব সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন না, কেননা এ ব্যাপারে সরকার কিছু শর্ত ঠিক করে দিয়েছে। সেক্ষেত্রে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ বা তার চেয়ে বেশি বয়সের যেকোনো বাংলাদেশি নারী, যেকোনো বাংলাদেশি শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী ও পুরুষ এবং ৬৫ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সি বাংলাদেশি নারী ও পুরুষ শুধু একক নামে পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন।
আর পেনশনার সঞ্চয়পত্র কেবল অবসরভোগী সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য এবং মৃত চাকরিজীবীর পারিবারিক পেনশন সুবিধাভোগী স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানেরা এ সঞ্চয়পত্র কিনে এর লভ্যাংশের সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
তবে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র কিন্তু সবার জন্য উম্মুক্ত। ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সি যেকোনো পেশার মানুষ একক বা যৌথ নামে এ দুই ধরনের সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। তবে অপ্রাপ্তবয়স্কদের পক্ষে আমানত রাখার এই গুরুত্বপূর্ণ খাতের এখন আর সুযোগ নেই।
সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে একসময় খুব একটা নিয়মকানুনের বালাই না থাকলেও এখন বদলে গেছে প্রেক্ষাপট। চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে নিয়মকানুন একটু কড়া করেছে সরকার। এক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের মুনাফার ওপর উৎসে কর কমিয়ে পাঁচ শতাংশে বেঁধে দিয়েছে সরকার। আবার এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে কিনতে হবে, জমা দিতে হবে আয়কর-টিন শনাক্তকারী নম্বরও। এ ছাড়া এখন লাগে গ্রাহকের নিজ ব্যাংক হিসাবের চেকের কপি, যে হিসাবে গ্রাহকের সুদ ও আসল টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হবে। পেনশনার সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে বাড়তি কাগজ হিসেবে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সম্মতি বা সনদ লাগবে।
অর্থ সঞ্চয় করে কোন ধরনের সঞ্চয়পত্র কিনবেন বলে যখন ঠিক করে ফেলেছেন, তখন সে সঞ্চয়পত্র কিনতে গিয়ে আপনার নিতে হবে নির্দিষ্ট ফরম। সাধারণত গ্রাহকদের এ ফরম পূরণ করতে হয়। সেইসঙ্গে দিতে হয় গ্রাহক ও নমিনির দুই কপি করে পাসপোর্ট আকারের ছবি। গ্রাহকের ছবি অবশ্য সত্যায়িত করতে হবে সরকারি কোনো প্রথম শ্রেণির কর্মচারীকে দিয়ে। আর নমিনির ছবির সত্যায়ন করবেন গ্রাহক নিজে। গ্রাহক ও নমিনির জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি এক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক। আর যদি নমিনি নাবালক কাউকে দেখাতে চান, তাহলে লাগবে জন্ম নিবন্ধনের সনদ।
তারপরও যারা নিয়মকানুন মেনে আমানত রেখে সবচেয়ে বেশি মুনাফা পেতে চাইছেন, সেসব গ্রাহকের জন্য সঞ্চয়পত্র ছাড়া ভরসার আর কোনো জায়গাই নেই। কারণটাও সহজ। এখনও সবচেয়ে বেশি সুদ বা মুনাফা পাওয়া যায় সঞ্চয়পত্র থেকেই।
এখন আসা যাক, ঠিক কত টাকার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন আপনি তা জানার বিষয়টি। কোনো একক নামে সবচেয়ে বেশি সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ রয়েছে কেবল পেনশনার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করে, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা। তবে এ সঞ্চয়পত্র যৌথ নামে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিনতে পারবে না। কোনো ব্যক্তির মা বা স্ত্রী কিংবা কোনো নারী তার নিজের নামে কেবল পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন ৪৫ লাখ টাকার মধ্যে। এটাও যৌথ বা যুগ্ম নামে কেনা যায় না।
এদিকে তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র একক নামে কেনা যায়, তবে তার সীমা ৩০ লাখ টাকার মধ্যে হতে হবে। আর যুগ্মভাবে কেনা হলে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত এ সঞ্চয়পত্র কেনা যায়। আবার পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রও একক ব্যক্তির নামে কেনা যায় ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত। এটিও ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত যুগ্ম নামে কেনা যায়।
ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রাখলে তার বিপরীতে যেমন ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নিতে পারেন বিনিয়োগকারীরা, তেমনি সঞ্চয়পত্র খাতে বিনিয়োগ করলে এর বিপরীতে ঋণ পাবেন না তারা। আবার নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সঞ্চয়পত্রে সুদহারও কম পাওয়া যায়।
একজন বিনিয়োগকারী পরিবার সঞ্চয়পত্রে এক লাখ টাকা রাখলে এখন পাবেন ৮৬৪ টাকা। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে তা তিন মাস অন্তর মুনাফা দুই হাজার ৪৮৪ টাকা। আর পেনশনার সঞ্চয়পত্রে তিন মাস অন্তর এই মুনাফা দুই হাজার ৬৪৬ টাকা। এসব সঞ্চয়পত্র যেমন কেনা যায়, তেমনি খুব সহজে যায় ভাঙানো। একই জায়গা থেকেও ভাঙানো যায় এগুলো।
এখন আসি মোদ্দাকথায়। বিনিয়োগ হিসাবে সঞ্চয়পত্র খাতের এই যে এলাহি ব্যাপারস্যাপার, তা ঠিক কতটা জানেন বিনিয়োগকারী। গত বছরের ১ জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্র বেচাকেনায় যে নতুন নিয়ম চালু করা হয়েছে, তার সম্পর্কে জানেন না বেশিরভাগ সঞ্চয়কারী। যদিও জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ডাকঘরের মতো সরকারের একাধিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে গ্রাহক সচেতনতা বাড়াতে বিজ্ঞাপন ও বার্তার মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তথ্য প্রদানের জন্য রাখা হয়েছে হেল্প ডেস্কও। তারপরও সচেতনতা বাড়ানো যাচ্ছে না গ্রাহকদের মাঝখানে নেই জানার ন্যূনতম আগ্রহও। ফলে একরকম সেবাদাতার মুখের কথার ওপরে বিশ্বাস রেখেই নিজের সারা জীবনের অর্থ লগ্নি করছেন তারা এ খাতে।
গণমাধ্যমকর্মী
srotkaberi@gmail.com