আবু নাছের টিপু: কয়েক বছর পর দেশে ফিরেছেন সাজ্জাদ সাহেব। পরিবার-পরিজন থাকেন চট্টগ্রামে। শেষবার যখন দেশে এসেছিলেন, তখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে যে ভোগান্তি হয়েছিল, তা এখনও তাকে পীড়া দেয়। তাই আগে থেকেই তিনি বড় ছেলেকে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের টিকিট কেটে রাখতে বলেছিলেন। দুঃখের বিষয় হলো ছেলে তা করেনি। মনে শঙ্কা নিয়ে তিনি দুপুরের পর সড়কপথেই চট্টগ্রাম যাত্রা শুরু করলেন ঢাকা থেকে।
গাড়ি যতই এগিয়ে যায় সাজ্জাদ সাহেব ততই বিস্মিত হন। এর আগে যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর সেতু পার হতেই আড়াই ঘণ্টা সময় লেগেছিল; কিন্তু আজ ভিন্ন দৃশ্যপট, ভিন্ন অভিজ্ঞতা। ছেলের ওপর মনের ভেতর যে রাগ ছিল তা কাটতে শুরু করেছে। পাঁচ মিনিটে পেরিয়ে গেলেন মেয়র হানিফ উড়াল সেতু। সাজ্জাদ সাহেবের মনে পড়ে বিদেশ যাওয়ার আগে ভিসার কাজে একবার ঢাকা এসেছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে ভালোয় ভালোয় ঢাকায় আসেন, কিন্তু শনির আখড়ার পর গাড়ি আর এগোয় না। পাক্কা দু’ঘণ্টা বসে থেকে শহরে ঢুকল। কী কষ্ট! অথচ আজ পাঁচ মিনিটেই পেরিয়ে গেল যাত্রাবাড়ী। অপার বিস্ময় তার চোখে-মুখে। শুধু তা-ই নয়, কাঁচপুরে কোনো যানজট নেই। চার লেনের নতুন সেতু। পাশে পুরোনোটি, দেখতে নতুনের মতোই। সেতু থেকে নামতে গিয়ে দেখলেন দৃষ্টিনন্দন ওভারপাসÑযার ওপর দিয়ে চাটগাঁমুখী বাস আর নিচ দিয়ে সিলেটমুখী; দারুণ ব্যবস্থাপনা।
গাড়ি গিয়ে পৌঁছল মেঘনা সেতুর টোল প্লাজায়। নেই সেই পুরোনো দৃশ্যপট। ডানপাশের ফাস্টট্র্যাক লেনে গাড়ি ঢুকে পড়ল অনায়াসে। টোল বুথের বাধাটি আপনা-আপনি সরে গেল। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আদায় হলো টোল। গাড়ি থামতে হলো না। ছেলের মোবাইলে সঙ্গে সঙ্গে এসএমএস এলো, তার অ্যাকাউন্ট থেকে টোলের সমপরিমাণ টাকা কর্তন করা হয়েছে। ছেলে বাবাকে এসএমএস দেখায়। কয়েক বছর পর দেশে ফেরা বাবার চোখে-মুখে বিস্ময়। এভাবেই তো বিদেশে টোল আদায় করা হয়। সাজ্জাদ সাহেব এতক্ষণে বুঝতে শুরু করলেন বদলে যাওয়া বাংলাদেশের গল্প। শঙ্কা নিয়ে শুরু করা ভ্রমণ ধীরে ধীরে আনন্দে রূপ নিতে শুরু করেছে।
সাজ্জাদ সাহেব হাতঘড়ি দেখলেন। মাত্র ৫০ মিনিটে পার হয়ে এলেন দাউদকান্দি সেতু, যা ছিল একসময় স্বপ্নের মতো। চার লেনের মহাসড়ক ধরে গাড়ি এগিয়ে চলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের দিকে। এ মহাসড়ক দেশের অর্থনীতির লাইফ-লাইন। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহভাগই এ পথেই। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের নতুন মাত্রা যোগ করেছে চার লেনে উন্নীত এ মহাসড়ক।
সাজ্জাদ সাহেবের মনে প্রশ্ন জাগেÑচার লেন হওয়ার পরও কেন তবে যানজট লেগে ছিল? ছেলে বাবাকে বুঝিয়ে দেয়, এতদিন মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হলেও মেঘনা আর গোমতি সেতু ছিল দুই লেনের। এর ফলে সেতুর প্রান্তে সৃষ্টি হতো যানজট। জট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোগান্তি বাড়ত যাত্রীদের। এ বাস্তবতায় সরকার তিনটি নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। তিনটি সেতুই চার লেনের। পাশাপাশি নেয় পুরোনো সেতুও সংস্কারের উদ্যোগ। জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) এগিয়ে আসে। প্রায় আট হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রহণ করে প্রকল্প। গত বছর ঈদুল ফিতরের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী তিনটি নতুন সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করে দেন। এ বছর ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে পুরোনো সেতু তিনটি সংস্কার শেষে যান চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করে দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী।
সাধারণত প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা দেয় ধীরগতি। এক্ষেত্রে তিনটি সেতু নির্মাণ এবং পুরোনো তিনটি সেতু সংস্কারে বাস্তবায়িত প্রকল্পটি দেশে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। আট হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প থেকে সাশ্রয় হয়েছে এক হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। এছাড়া নতুন তিনটি সেতুর নির্মাণকাজ নির্দিষ্ট সময়ের ছয় মাস আগে এবং বিদ্যমান তিনটি সেতুর সংস্কারকাজও সময়ের আগেই শেষ হয়েছে।
গাড়ি এগিয়ে চলে। ধীরে ধীরে মন ভালো হতে থাকে সাজ্জাদ সাহেবের। প্রশস্ত সড়কের দু’পাশে বিস্তৃত সবুজ। মাঘের সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। চারদিকে গোধূলির আভা। সড়ক বিভাজনে লাগানো ফুলগাছে ফুটেছে নানা রঙের ফুলÑকোথাও রক্তকরবি, কোথাও রাধাচূড়া। প্রস্ফুটিত ফুল ভ্রমণ-আনন্দ বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় নির্মিত হয়েছে দেশের প্রথম আন্ডারপাস। সেনানিবাসের দু’পাশের বসতিকে যুক্ত করেছে পাতাল সংযোগ।
২
মহাসড়ক দিয়ে স্বচ্ছন্দে চলাচল করছে যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী পরিবহন। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এ মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের চাপ দিন দিন বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্যবাহী যানবাহন আগে শহরের ভেতর দিয়ে মহাসড়কে আসত। ফৌজদারহাট থেকে বন্দর পর্যন্ত নির্মিত বাইপাস এবং বন্দর সংযোগ উড়ালসেতু নির্মাণের ফলে শহরকে বাইপাস করে সরাসরি মহাসড়ক হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্যবাহী যানবাহনের যাতায়াত সহজতর হয়েছে।
মহাসড়কের স্থায়িত্ব সুরক্ষায় সরকার যানবাহনের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে প্রণয়ন করেছে এক্সেল লোড কন্ট্রোল নীতিমালা। মেঘনা সেতুর টোল প্লাজা ছাড়াও সীতাকুণ্ডে স্থাপন করা হয়েছে অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। এর ফলে মহাসড়কে অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাপনা উন্নত হয়েছে। কমে এসেছে যানজট। চার লেনের ফলে যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে যে দুর্ঘটনা ঘটে, তা বন্ধ হয়েছে। ভ্রমণ সময় অর্ধেকে নেমে আসায় ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছেন।
এরই মাঝে সরকার দেশের প্রধান প্রধান মহাসড়ক পর্যায়ক্রমে চার লেনে উন্নীত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে এরই মধ্যে এক হাজার ৭৫২ কিলোমিটার মহাসড়কের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, পাচ্চর-ভাঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। এডিবির অর্থায়নে গাজীপুর-এলেঙ্গা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ শেষ হতে চলেছে। শুরু হয়েছে এলেঙ্গা-রংপুর চার লেনের কাজ। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের কাজ মার্চ মাসে শেষ হতে যাচ্ছে। এটি দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। চার লেন ছাড়াও এ মহাসড়কের দু’পাশে ধীরগতির যানবাহনের জন্য থাকছে দুটি আলাদা লেন। এছাড়া ঢাকা বাইপাস সড়ক, ময়নামতি-বেগমগঞ্জ-সোনাপুর, ফেনী-চৌমুহনী ও কক্সবাজারের মাতারবাড়ী সংযোগ সড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু হয়েছে।
পথিমধ্যে হাইওয়ে-সংলগ্ন রেস্টুরেন্টে সংক্ষিপ্ত চা বিরতি শেষে আবার চলতে শুরু করেন সাজ্জাদ সাহেব। কুমিল্লার পদুয়ারবাজার আর ফতেপুর রেলওয়ে ওভারপাস পেরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে। আগে এ দুটি স্থানে ট্রেন আসা-যাওয়ার জন্য অনেক সময় বসে থাকতে হতো। এখন আর সে ঝামেলা নেই। ফেনীর মহিপালে ছয় লেনের ফ্লাইওভারে জ্বলে উঠেছে উজ্জ্বল আলো। এ আলোর বন্যায় এক নতুন বাংলাদেশ দেখতে পান তিনি। তার মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে দেন। ছুটে চলা গাড়িতে বসে প্রিয় জন্মভূমির স্নিগ্ধ বাতাস শরীরে মাখেন। প্রিয় সন্তানের কাছে তখনও শুনতে থাকেন সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের কথা, চট্টগ্রামকে ঘিরে সরকারের নানা পরিকল্পনার কথা। এরই মধ্যে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের প্রায় অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে বলে জানতে পারেন তিনি। এ টানেলের প্রায় এক হাজার ৩০০ মিটার খননকাজ সম্পন্ন হয়েছে। নির্মাণকাজ শেষ হলে বদলে যাবে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের দৃশ্যপট। নদীর ওপাড়ে গড়ে উঠবে আরেক শহর। সম্প্রসারিত হবে ব্যবসা-বাণিজ্য। এ উন্নয়নযজ্ঞের সঙ্গে মিল রেখে চট্টগ্রাম থেকে দেশের পর্যটন নগরী কক্সবাজার পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এদিকে পর্যটকদের মন কেড়েছে নয়নজুড়ানো মনোহর কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ।
সাজ্জাদ সাহেবের গাড়ি সিটিগেট হয়ে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করেছে। ঘড়ি দেখে অবাক তিনি! মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টায় রাজধানী শহর থেকে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম! নেই কোনো ভ্রমণক্লান্তি। এতদিন প্রবাসে দেশের কত নেতিবাচক গল্প শুনেছেন। আজ নিজ চোখে দেখে বিস্মিত হয়েছেন। দেখেছেন অদম্য গতিতে এগিয়ে যাওয়া এক নতুন বাংলাদেশ। অন্যান্য খাতের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যব্যস্থার উন্নয়নে তিনি মুগ্ধ। মুগ্ধতার রুপালি পরশ শরীর আর মন ছুঁয়ে যায়। আনন্দময় ভ্রমণের রেশ ধরে রেখেই দীর্ঘদিন পর দেশে ফেরা সাজ্জাদ সাহেব প্রবেশ করেন জাকির হোসেন সড়কে নিজ বাড়ির আঙিনায়।
পিআইডি নিবন্ধ