সড়কে নিরাপত্তায় করণীয়

দিন দিন দেশের মানুষের জীবনের মানোন্নয়ন হচ্ছে, রাস্তার উন্নয়ন হচ্ছে, বাড়ছে সম্ভাবনা। কিন্তু সড়কের নিরাপত্তা আইন মেনে চলছে না কেউ, কমছেই না দুর্ঘটনা আর মৃতের সংখ্যা। মানুষের জীবন যেন একান্তই মূলহীন সড়কে। লাসেন্সবিহীন বেপরোয়া মদ্যপায়ী অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক যার গাড়ির নেই ফিটনেস। হচ্ছে না মৃত্যুর অবসান, লাশের ওপর দিয়ে চলছে চাকা। কারণ সমাধান যে শুধুই কিছু টাকা। সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই এত মানুষ প্রাণ হারালেও এর মধ্যে খুব অল্প ঘটনা গণমাধ্যমে উঠে আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব নিয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয় না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনার আলোকে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) সর্বশেষ জরিপটি পরিচালনা করেছে। জরিপে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে ৩০০ মানুষ বিভিন্ন ধরনের আঘাতজনিত কারণে মারা যায়, ৬৬০ জন পঙ্গু হয় ও ৫৫ হাজার মানুষ কোনো না কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী সব বয়সীদের মধ্যেই আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনা ও পানিতে ডুবা আঘাতজনিত মৃত্যুর প্রধান তিন কারণ। তবে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের আলাদাভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনা রয়েছে শীর্ষে। নয় বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের ডুবে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। তবে ১০-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে আঘাতজনিত মৃত্যুর দিক থেকে এগিয়ে আত্মহত্যা। অন্যদিকে ২৫-২৯ বচর বয়সীদের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় অধিক মৃত্যু হয় বলে উঠে এসেছে। এ ধরনের প্রথম জরিপ ২০০৩ সালে করা হয়েছিল। তবে সেবার শুধু শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

২০২১ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এ সময়ের মধ্যে রেলপথে ৬০৬টি দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত, ২০১ জন আহত হয়েছেন। নৌ-পথে ২৬২টি দুর্ঘটনায় ৩৫৭ জন নিহত এবং ৩৫৭ জন আহত হয়েছে। নৌ দুর্ঘটনায় নিখোঁজ ৭৪৩ জনের কোনো সন্ধান এখনও মেলেনি। সব মিলিয়ে সড়ক, রেল ও নৌ-পথে ৭ হাজার ৬১৭টি দুর্ঘটনায় ১০ হাজার ৮৫৮ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৮৭৫ জন আহত হয়েছেন। ২০২৩ সালেও কম মৃত্যু হয়নি, তবে তা কতটা তা বোঝা যাবে পূর্ণ রিপোর্ট এলেই। ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় গত আট বছরের মধ্যে রেকর্ড সংখ্যক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

আদালতের আদেশ অমান্য করে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলার চলাচলকে দুর্ঘটনা বাড়ার একটি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আবার বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণও বলছে, বেপরোয়া গতি, বিপদজনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধে চলাচল, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, চালকের বেপরোয়া মনোভাব, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা, রাস্তায় ফুটপাথ না থাকা বা ফুটপাথ বেদখলে থাকা, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, ছোট যানবাহনের ব্যাপক বৃদ্ধি, সড়কে চাঁদাবাজি, রাস্তার পাশে হাট-বাজার, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় নামানো, মালিকের অতিরিক্ত মুনাফার মানসিকতা, চালকের নিয়োগ ও কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট না থাকা, দেশব্যাপী নিরাপদ ও আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থার পরিবর্তে টুকটুকি-ইজিবাইক-ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা নির্ভর গণপরিবহন ব্যবস্থা সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।

দুর্ঘটনা এড়াতে করণীয়: আইনের ত্রুটি চিহ্নিত করে গাড়ির সর্বোচ্চ ফিটনেস ও চালকের সকল প্রকার যোগ্যতা কঠোরভাবে নিশ্চিত করা ও যে কোনো অপরাধের সঠিক এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ ও বিধিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা। সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে আলাদা সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট গঠন করা। সড়ক নিরাপত্তায় ইতোমধ্যে প্রণীত যাবতীয় সুপারিশমালা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া। দেশের সব সড়ক-মহাসড়কে ট্রাফিক চিহ্ন স্থাপন করা। দেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তায় সাধারণ জনগণেরও নিজ নিজ দায়িত্ব পালন ও সচেতনতা দরকার।

আবদুল কাদের নাগিব
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়