ড. আবদুল জলিল: ব্যাপক শৃঙ্খলাহীনতা, তীব্র যানজট এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে আমাদের শহরের রাস্তাগুলো নিত্যদিন একটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই পরিস্থিতি, মূলত ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, ফিটনেসবিহীন যানবাহন এবং পদ্ধতিগত দুর্নীতির কারণে সৃষ্ট। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বেপরোয়া ও অনিয়ন্ত্রিত ড্রাইভিং এবং ব্যাপক দুর্নীতির সমন্বয়ে আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনা একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে যা আমাদের জীবনযাত্রার মান, অর্থনীতি এবং আমাদের দেশের ভাবমূর্তিকে দারুণ ভাবে ভূলণ্ঠিত করছে। আমাদের রাস্তাগুলোর বর্তমান বিশৃঙ্খল অবস্থার ওপর নজর দিয়ে তাকে নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল করার জন্য ব্যবহারিক সমাধানগুলো সামনে আনা এখনই উপযুক্ত সময়।
বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির একটি প্রাথমিক কারণ হলো অধিকাংশ এলাকায় স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থার অভাব। বর্তমানে, ট্রাফিক পুলিশ ম্যানুয়ালি ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে, যা প্রায়ই অদক্ষ এবং অসঙ্গত। পিক আওয়ারে, পুলিশ কর্মকর্তাদের যানবাহন প্রবাহ পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে দেখা যায় এবং প্রায়ই, অব্যবস্থাপনায় আরও বেশি যানজট এবং বিভ্রান্তির দিকে পরিচালিত হয়। স্বয়ংক্রিয় সংকেত প্রয়োগ করা গেলে তা কেবল ট্র্যাফিককে স্ট্রিমলাইন করবে না বরং ম্যানুয়াল হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভরতাও কমিয়ে দেবে, যা মসৃণ এবং আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ ট্র্যাফিক প্রবাহের পথ উন্ম–ক্ত করবে।
আমাদের ট্রাফিক সমস্যার আরেকটি বড় কারণ হলো সীমিত সংখ্যক বিকল্প রাস্তা। ঢাকার মতো নগরগুলোতে জনসংখ্যা যেমন- দ্রুতগতিতে বাড়ছে, তেমনি গাড়ির সংখ্যাও বাড়ছে। অথচ আমাদের সড়ক অবকাঠামো আনুপাতিকভাবে সম্প্রসারিত হয়নি। ফলস্বরূপ, কয়েকটি প্রধান সড়কে বিপুল পরিমাণ যানবাহন চলাচলে বাধ্য হচ্ছে এবং তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এই অপর্যাপ্ত সড়ক নেটওয়ার্ক চলাচলকারী অসংখ্য যানবাহনের জন্য খুবই অপ্রতুল এবং এমতাবস্থায় যদি কোনো দুর্ঘটনা বা রাস্তা অবরোধের ঘটনা ঘটে তাহলে তা ট্র্যাফিক জ্যামকে অসহনীয় করে তোলে এবং এর পরিণতিতে অগণিত মানুষের যাতায়াত দুর্বিষহ করে তোলে।
উপরন্তু এই তীব্র যানজটের সঙ্গে যুক্ত হয় অসংখ্য ফিটনেসবিহীন যানবাহন-বিশেষ করে বাস এবং ট্রাক-যা ক্রমাগত কালো ধোঁয়া নির্গত করে বায়ুকে দূষিত করে তোলে এবং জনস্বাস্থ্যের চরম ক্ষতি সাধন করে। যদিও এই যানবাহনগুলো রাস্তায় থাকা একদম নিষিদ্ধ ছিল, তবুও অনেকেই চালিয়ে যাচ্ছেন কারণ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ঘুষের বিনিময়ে খুব সহজেই ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়া যায় বলে। ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকে নির্গত বিপজ্জনক কালো ধোঁয়ায় মারাত্মকভাবে বায়ুদূষণ ঘটে, যা শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতার বৃদ্ধিতে বেশ বড় ভূমিকা রাখে এবং আমাদের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানকে হ্রাস করে।
ক্ষমতাবান ব্যক্তি যেমন- রাজনৈতিক নেতা এবং ব্যবসায়ী মহল, যারা পাবলিক বাসের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মালিক, তাদের প্রভাবে মূলত এই পরিস্থিতি এতটা জটিল হয়ে উঠেছে। অধিকাংশ যাত্রীবাহী যানবাহন নিরাপত্তা বিধি না মেনে প্রায়ই যত্রতত্র লেন ব্লক করে যাত্রী তোলার কারণে অতিরিক্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পাশাপাশি, এনফোর্সমেন্ট এজেন্সিগুলো ঘুষ এবং রাজনৈতিক চাপের প্রভাবে নতি স্বীকার করে তাদের চোখ বন্ধ রাখেন। ট্রাফিক পুলিশ, যাদের শৃঙ্খলা রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করা উচিত ছিল, তারা প্রায়ই আইন লঙ্ঘনকারীকে চ্যালেঞ্জ না করে ঘুষের বিনিময়ে চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়।
তাছাড়া রাস্তায় চলাচলকারী রিকশার আধিক্য যানজটকে আরও বাড়িয়ে তোলে যদিও অনেকের জন্য এটা একটি সাশ্রয়ী বাহন। অনেক কম সংখ্যক যানবাহনের জন্য ডিজাইন করা শহরের রাস্তায় হাজার হাজার রিকশার উপস্থিতি যানজট সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্যভাবে ভূমিকা রাখছে। এই সমস্যাগুলো নিত্য চলাচলকারী যাত্রীদের জন্য প্রতিদিন চরম দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রিডলকড ট্রাফিক প্রতি বছর লাখ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট করে, যা অর্থনৈতিক মানদণ্ডে বিলিয়ন টাকার সমান। তাছাড়া এই পরিস্থিতি আমাদের জাতীয় ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করে; বিদেশি পর্যটক এবং বিনিয়োগকারীরা আমাদের শহুরে পরিবেশের একটি নেতিবাচক ধারনা নিয়ে যান, যা পর্যটন এবং ব্যবসার সুযোগকে নিরুৎসাহিত করে। উপরন্তু ফিটনেসবিহীন যানবাহন দ্বারা উৎপন্ন দূষিত বায়ু ও সূক্ষ্মকণা পরিবেশের দূষণ বাড়িয়ে তোলে এবং স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা সৃষ্টিতে বেশ বড় ভূমিকা রাখে।
আমাদের সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এটা মোকাবিলা করার জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়া দরকার। এখানে বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা কথা বলা যায় যা এই অবস্থার অর্থপূর্ণ উন্নতি আনতে পারে:
স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিস্টেম: রিয়েল-টাইম ট্রাফিক মনিটরিং সিস্টেমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ইনস্টল করা গেলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে ব্যাপকভাবে উন্নত করা যাবে। ম্যানুয়াল নিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সিস্টেমটি গতিশীলভাবে ট্র্যাফিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম এবং তা মানুষের দুর্ভোগ কমাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।
সড়ক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং উন্নত করুন: শহরগুলোর দ্রুত নগরায়ণের সঙ্গে, সরকারের উচিত অবকাঠামো সম্প্র্রসারণকে অগ্রাধিকার দেয়া। বিকল্প রুট তৈরি করা এবং পেরিফেরাল রাস্তা সংযুক্ত করা যা ট্রাফিককে বিভাজিত করার মাধ্যমে প্রধান সড়কের ওপর চাপ কমিয়ে দিতে পারে। উপরন্তু ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস এবং রাস্তা প্রশস্তকরণ প্রকল্পে
বিনিয়োগের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ এলাকার যানজট নিরসন করা যেতে পারে।
যানবাহনের ফিটনেস এবং নির্গমন স্ট্যান্ডার্ডের কঠোর প্রয়োগ: সব যানবাহনকে নিয়মিত ফিটনেস এবং নির্গমন পরীক্ষা পাস করতে হবে। টেম্পারিং রোধ করতে সার্টিফিকেশন ডিজিটাল রেকর্ড-কিপিং সাপেক্ষে হওয়া উচিত এবং ঘুষ বা জালিয়াতির মাধ্যমে সার্টিফিকেট প্রদান করা হলে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা উচিত। এই সংস্কার শুধু দূষণই কমাবে না উপরন্তু তা রাস্তাকেও নিরাপদ রাখবে।
ট্রাফিক আইন প্রয়োগকে শক্তিশালী করা: আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অবশ্যই ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের প্রতি শূন্য-সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করতে হবে। বার বার নিয়ম ভঙ্গকারী অপরাধীদের, বিশেষ করে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চালকদের, মোটা অঙ্কের জরিমানার বিধান রাখতে হবে। উপরন্তু ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি বন্ধে নিয়মিত অডিট এবং তদারকির আওতায় নিয়ে আসা দরকার।
বিকল্প পরিবহন: বিকল্প ট্রান্সপোর্ট যেমন- মেট্রোরেল, যা একসঙ্গে অনেক যাত্রী পরিবহনে সক্ষম এ ধরনের বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে পাশাপাশি জনসাধারণকে সাইকেল চালানো এবং হাঁটার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে প্রচার প্রচারণা চালালে অনেকেই এ ব্যাপারে উৎসাহিত হবেন যা আমাদের রাস্তার ওপর চাপ কমিয়ে দিতে পারে তবে এর জন্য আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। নাগরিকদের টেকসই পরিবহন পদ্ধতি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে তা শুধুমাত্র যানজট কমাবে না বরং বায়ুর মানও উন্নত করবে।
জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান: ট্রাফিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধিতে জনশিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতামূলক প্রচারাভিযানে, রাস্তার শৃঙ্খলা, পথচারীদের নিরাপত্তা এবং ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলার সামগ্রিক সুবিধার গুরুত্ব তুলে ধরা উচিত। এই মূল্যবোধের ওপর জোর দেয়া সবার দায়িত্ব যা সম্মানের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সাহায্য কররে।
একটি সুশৃঙ্খল সড়ক সংস্কৃতি একটি সভ্য সমাজের বড় বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, কিন্তু আমাদের সড়কের অবস্থা আমাদের অর্জনে নেতিবাচকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। আমাদের রাস্তায় শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার করতে সব নাগরিককে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সরকারী সংস্থাগুলোকে সহযোগিতা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিকদের কাছে, ভবিষ্যৎ প্রজšে§র কাছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে রাস্তায় শৃঙ্খলা ও সম্মান বজায় রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।