সড়ক হোক সবার জন্য নিরাপদ

মুহাম্মদ ফয়সুল আলম: ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়কে বাস ও মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে মোটরসাইকেলচালক ও কলেজ ছাত্র ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন। এ ঘটনাগুলো প্রায়ই ঘটে থাকে চালকদের অসাবধানতার কারণে। দেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ, আহত হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন অনেকে। সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার ব্যাপকতা যেন কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন মানুষ। প্রতিটি মৃত্যুই বেদনার। সড়ক দুর্ঘটনায় যিনি মৃত্যুবরণ করেন তার পরিবারকে দীর্ঘকাল ধরে বয়ে বেড়াতে হয় দুঃসহ যন্ত্রণা। আর যারা প্রাণে বেঁচে যান অঙ্গ-প্রতঙ্গ হারিয়ে, তাদের জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। বেঁচেও তারা ভোগ করেন মৃত্যুসম যন্ত্রণা। কর্মশক্তি হারিয়ে পরিবার ও সমাজের জন্য হয়ে যান বোঝা।

দুর্ঘটনায় প্রাণ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বিশ্বব্যাপী একটি অন্যতম প্রধান সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জনস্বাস্থ্যগত সমস্যা। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় এক কোটি চল্লিশ লাখ লোক দুর্ঘটনার শিকার হয় এবং এগারো লাখেরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এসব দুর্ঘটনার কারণে বছরে জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ হারাচ্ছে দেশ। কাজেই সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হবে যে কোনো উপায়ে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাব। মহাসড়কে অপরিকল্পিত স্পিডব্রেকার বা গতিরোধকগুলোও দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। এছাড়া ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়কের পাশে হাটবাজার বসা, চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব প্রভৃতি কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে বলে মনে করি আমরা। তাছাড়া চালকদের দক্ষতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে। মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কাজটি করতে হবে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী। যত্রতত্র গতিরোধক নির্মাণ রোধে নিতে হবে কার্যকর ব্যবস্থা। অভিযোগ আছে, অনেক পরিবহন মালিক চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দেন না। ক্লান্ত-শ্রান্ত চালক গাড়ি চালালে স্বভাবতই তাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার উঁচু। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৮০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে বিরামহীন গাড়ি চালনা, অত্যধিক গতিতে গাড়ি চালনা এবং চালকের অসাবধানতার কারণে। একজন চালক একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় গাড়ি চালাবেন, এটাই নিয়ম। কিন্তু দেশের কোনো চালকই এ নিয়ম পালন করেন না। ফলে একজন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত চালক যখন গাড়ি চালান, তখন স্বভাবতই দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে বেশি। এ জন্য মূলত বাস মালিকদের অত্যধিক ব্যবসায়িক মনোভাবই দায়ী।

২০২১ সালে দেশে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন। আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও বেপরোয়া গতি। যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, সড়কের সাইন-মার্কিং-জেব্রা ক্রসিং চালক এবং পথচারীদের না মানার প্রবণতা, রাস্তায় হাঁটা ও পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা, হেডফোনে গান শোনা, চ্যাটিং করা এবং সড়ক ঘেঁষে বসতবাড়ি নির্মাণ ও সড়কের ওপরে হাটবাজার গড়ে ওঠা ইত্যাদি কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়াচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা সরকারের অগ্রাধিকার। যদিও বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, তথাপি দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে প্রচেষ্টাও চলছে অবিরাম। আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছে সরকার। আশার কথা হলো, নানামুখী প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস এবং অংশীজনদের সহযোগিতায় ইতোমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসছে। সড়ক নিরাপত্তার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন ২০১৮ সালের জুনে। নির্দেশনাগুলো হলোÑদূরপাল্লার গাড়িতে বিকল্প চালক রাখা, একজন চালকের পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানো, চালক ও তার সহকারীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর সড়কের পাশে সার্ভিস সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি করা, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা বা সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবহার এবং চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নির্দেশনাগুলো পালন করছেন সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রণালয়। এছাড়া সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল কর্তৃক গঠিত কমিটির ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নের নিমিত্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিআরটিএ সম্পর্কিত সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নকল্পে একটি সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

নিরাপদ ও ভ্রমণবান্ধব সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা সরকারের অগ্রাধিকার। সড়ক  পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকর করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় আইনগত কাঠামোর সঙ্গে সমন্বয় করে ন্যাশনাল রোড সেফটি স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী মহাসড়কের পাশে পণ্যবাহী যানবাহন চালকদের জন্য  বিশ্রামাগার নির্মাণের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। দুর্ঘটনার জন্য অনেক সময় সড়ক-মহাসড়কের নির্মাণ-ত্রুটিকে দায়ী করা হয়। ত্রুটি অপসারণের পাশাপাশি এআরআইর সহায়তায় দেশব্যাপী বিভিন্ন মহাসড়কে ১৪৪টি দুর্ঘটনাপ্রবণ স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। এরই মাঝে গৃহীত প্রকল্পের আওতায় ১২১টি স্পটের ঝুঁকি প্রবণতা হ্রাস করা হয়েছে।

আধুনিক সড়ক ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে উন্নত বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও চালু করা হয়েছে রোড সেফটি অডিট। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে যানবাহনের ক্রমবর্ধমান চাপ বেড়ে যাওয়ায় সরকার মহাসড়কসমূহ পর্যায়ক্রমে চার বা ততধিক লেনে উন্নীত করার কাজ করে যাচ্ছে। বিগত বছরগুলোয় প্রায় সাড়ে ৪০০ কিলোমিটার মহাসড়ক চার বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে, ফলে এসব মহাসড়কে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বর্তমানে প্রতিটি মহাসড়কের পাশে ধীরগতির যানবাহনের জন্য আলাদা লেন নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া মহাসড়কে ছোট আকারের যানবাহন দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে; তাই সরকার মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করে দেয়।

দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতকরণে প্রয়োজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চালক। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে সরকার পেশাজীবী গাড়ি চালকদের প্রশিক্ষণ সুবিধা বাড়িয়ে চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে দক্ষ ও মানবিক গুণসম্পন্ন গাড়িচালক তৈরির লক্ষ্যে ২০০৮-২০০৯ অর্থবছর হতে ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের পূর্বে পেশাজীবী গাড়িচালকদের বাধ্যতামূলকভাবে স্বল্পমেয়াদি রিফ্রেশার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের ৭ লাখ ৬ হাজার ৮৮ জন গাড়িচালকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। গাড়িচালকদের জেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, যা পর্যায়ক্রমে উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হবে। পেশাজীবী চালককে সড়ক নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। নারী গাড়িচালক তৈরির সুযোগও বাড়ানো হয়েছে।  গাড়িচালকদের লাইসেন্স এবং যানবাহন রেজিস্ট্রেশনে জালিয়াতি বন্ধে বায়োমেট্রিক্সসমৃদ্ধ স্মার্টকার্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। নম্বরফলকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি সরবরাহ করা হচ্ছে রেট্রোরিফ্লেক্টিভ ট্যাগ।

বিআরটিএর পরিবহনবিষয়ক সেবা সহজীকরণ করা হয়েছে। যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। পরিবহন মালিকদের সহযোগিতায় ইতোমধ্যে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানের অননুমোদিত বাম্পার অপসারণ করা হয়েছে সফলভাবে। সড়ক নিরাপত্তায় পথচারী তথা সড়ক ব্যবহারকারীদের সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাফিক আইন মেনে চলার পাশাপাশি যানবাহন চালানো অবস্থায় সিটবেল্ট বাঁধা এবং চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। জনগণকে ফুটওভারব্রিজ ব্যবহারে সচেতন করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক করা হয়েছে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীর জন্য হেলমেট ব্যবহার। ঢাকা শহর ও দেশের অন্যান্য স্থানে পুরোনো ও ত্রুটিপূর্ণ মোটরযান এবং অদক্ষ লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাক-প্রাথমিক থেকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

কারও একার পক্ষে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়। এ কাজে সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, পরিবহন মালিক, শ্রমিক, যাত্রী, পথচারী দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সমাজের বিভিন্ন অংশীজন তথা সড়ক ব্যবহারকারীদের সচেতনতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রোধ করা যাবে সড়ক দুর্ঘটনা।

পিআইডি নিবন্ধ