মোহাম্মদ আবু নোমান: সত্যের অনন্য আলোয় মিথ্যার অন্ধকার দূরীভূত হোক। নতুন বছরে নতুন স্বদেশ, নতুন ধরা বিনির্মাণে সবাই নোয়াখালীর আওয়ামী লীগের নেতা ও বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার মতো সত্যের সহযাত্রী হবেন, এটাই কামনা। প্রকৃতপক্ষে সর্বসাধারণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও সম্মান অনেক বেশি। জনপ্রতিনিধি হতে হলে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হতে হয়। তাহলেই কোনো জনপ্রতিনিধি এলাকার সম্মানিত ব্যক্তি বা জননন্দিত নেতা হিসেবে পরিগণিত হন। আবদুল কাদের মির্জা যা বলেছেন, এটা শুধু তার নিজের কথা নয়, এটা দেশের জনগণেরই কথা। কেউ হয়তো সাহস করে বলতে পারেন না, কিন্তু সত্য কখনও চেপে রাখা যায় না। দেশের একজন বিবেকবান নাগরিকের মতো আবদুল কাদের মির্জা সত্য কথা বলেছেন।
নির্বাচনী ব্যবস্থা যখন কোমায়!
এমন নির্বিশঙ্ক সত্য কথা কয়জনই বা বলতে পারেন? এর আগে নির্বাচনসংক্রান্ত গুরুতর অসদাচরণ ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন দেশের ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো হলো আর্থিক অনিয়ম এবং জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে অসদাচরণ। ইসির বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তার তদন্ত করতে রাষ্ট্রপতির কাছে ৪২ নাগরিকের চিঠিকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে জানিয়েছে ইসি। কিন্তু এখন ইসির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে। বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতিরও দরকার নেই, দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থাই যখন কোমায় চলে গেছে। গত নির্বাচনগুলো কীভাবে হয়েছে, তা সাত-আট বছর বয়সের মাসুম শিশুও জানে। এর দায় তো কমিশনকেই নিতে হবে; প্রভাবকরাও দায় এড়াতে পারেন কি? সম্প্রতি আবদুল কাদের মির্জা প্রশাসনের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘তারা অনেক উড়ছেন, তারা মনে করেন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় এনেছেন তারা। শেখ হাসিনা চাইছেন ফল, তারা এনে দিয়েছেন গাছসহÑকত অতি উৎসাহী। প্রশাসনের কিছু লোক এসব করেছেন শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য।’
আসলে ফল আনতে গিয়ে কিছু ডালপালা বা গাছগাছড়া ভাঙা মেনে নেয়া গেলেও গাছের শিকড়সহ উপড়িয়ে-চোপড়িয়ে নিয়ে এসে পুরো বন ধ্বংস করে দেয়া দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। এটা দল ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের বুঝতে হবে।
নীতি কী জিনিস ভুলে যান
রাজনীতির মারপ্যাঁচ বোঝা বড়ই মুশকিল। আবদুল কাদের মির্জার ওই বক্তব্য রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের অংশ কি না, এখনও বলা যাচ্ছে না। সুবিধাহীনতার কারণে, মনের রাগে-অভিমানে কিছু সত্য কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। সুবিধা পেয়ে গেলে আবার আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া! যেমন নিক্সন চৌধুরীসহ অনেককেই দেখা গেছে, যে মাত্র পদ পেয়েছেন, তাদের ভাষা ও সুর দুটোই উল্টে গেছে। এসব নীতিবান কথা বলার উদ্দেশ্য ভালো পদ পাওয়া; জনসমর্থন পাওয়া কি না, তা সময়ই বলে দেবে। আমরা আগেও দেখেছি এরকম বহু নেতা একটু ওপরে ওঠার নেশায় আসক্ত হয়ে কৌশল হিসেবে খুব নীতিপূর্ণ কথা বলেছেন। মানুষ বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে লাভ রিঅ্যাক্ট দেয়ার পরবর্তী সময়ে পদ পাওয়ার পর নীতি কী জিনিস পুরোটাই ভুলে গেছেন। সময়ের পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিচরিত্র ও রূপ পাল্টানো নতুন নয়! আজ যিনি আওয়ামী লীগ, কাল তিনি বিএনপির বড় নেতা; আবার যিনি ছিলেন বিএনপির বড় নেতা, তিনি হয়ে যান আওয়ামী লীগের বড় নেতা। পাওয়া না পাওয়ার কষ্ট ও যন্ত্রণা থেকেই এ সাতকাহন। সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের চরিত্রই এমন। কেউ তেল মর্দন করে কৌশলগতভাবে স্বার্থ হাসিল করেন, আবার কেউবা ইস্পাতকঠিন বক্তব্য ও তীব্র সমালোচনা করে স্বার্থ আদায় করে নেন।
আবদুল কাদের মির্জার সত্যভাষণ
তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে আসা আবদুল কাদের মির্জা কেবল আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা নন, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সহোদর। সম্প্রতি বসুরহাট পৌরভবন চত্বরে নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণাকালে আবদুল কাদের মির্জা বলেছেন, ‘বৃহত্তর নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের কিছু কিছু চামচা নেতা আছেন, যারা বলেন, অমুক নেতা তমুক নেতার নেতৃত্বে বিএনপির দুর্গ ভেঙেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীতে তিন-চারটা আসন ছাড়া বাকি আসনে আমাদের এমপিরা দরজা খুঁজে পাবেন না পালানোর জন্য। এটাই হলো সত্য কথা। সত্য কথা বলতে হবে। আমি সাহস করে সত্য কথা বলছি।’ এছাড়া নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় দলীয় কিছু নেতাকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, ‘নোয়াখালীর মানুষজন বলে, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এটা সত্য। কিন্তু আপনাদের (নোয়াখালীর আওয়ামী লীগ নেতা) জনপ্রিয়তা বাড়েনি। আপনারা প্রতিদিন ভোট কমান। টাকা দিয়ে বড় জনসভা করা, মিছিল করা কোনো ব্যাপার নয়। টাকা দিলে, গাড়ি দিলে, আমিও অনেক লোক জড়ো করতে পারব; নাহয় রাজনীতি থেকে বিদায় নেব।’
আওয়ামী লীগের যেসব নীতিনির্ধারক নির্বাচন সম্পর্কে বিরোধী দলের সমালোচনাকে বিএনপি-জামায়াত চক্রের অপপ্রচার বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চান, তারা আবদুল কাদেরের কথাগুলো আমলে নেবেন আশা করি। তিনি বিএনপি-জামায়াত চক্রের কেউ নন। ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দল রাখতে না চাইলেও দলের মধ্য থেকেই বিরোধিতা তৈরি এবং নিজদলীয় নেতাদের মুখ দিয়েই এখন সত্যবাণী বের হচ্ছে। মির্জা আবদুল কাদের সৎসাহস নিয়ে রাজনীতির বাস্তব চিত্রটাই তুলে ধরেছেন, যা অতীত-বর্তমান উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অপ্রিয় হলেও সত্য কথা বলেছেন! বর্তমানে বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তির কাছ থেকে ন্যায় ও বাস্তব কথাগুলো শোনা যায় না!
সত্য বলা বড় কঠিন
সত্য সবাই বলতে পারে না। এ শক্তি সবার নেই। তবে বর্তমানে রাজনীতি করা, দল করা যত সহজÑপ্রতিবাদ করা, সত্য বলা অত সহজ নয়। যেখানে সবাই তোষামোদে ব্যস্ত, সেখানে সত্য বলতে হিম্মত লাগে। স্রোতের প্রতিকূলে অবস্থান করে নিজদলের নেতাদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্য ফাঁস, সুষ্ঠু নির্বাচন দাবি, রাজনীতির সঠিক অবস্থান তুলে ধরা সহজ নয়। রাজনীতিতে ন্যায় ও সত্যের মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই। সত্য বলার অপরাধে হয়তো কাদের মির্জাকে শোকজ করা হবে, এমনও হতে পারে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি! কাদের মির্জার মতো সত্যবাদী ও সাহসী প্রবীণ রাজনীতিবিদ বাংলাদেশে খুবই প্রয়োজন। সত্য কথা সমালোচনার ভয়ে অনেকেই বলতে চান না। কথায় আছেÑ ‘উচিত কথায় মাওই বেজার, ডাল-ভাতে বিড়াল বেজার।’
কারও নাম উল্লেখ না করে আবদুল কাদের বলেন, ‘প্রকাশ্য দিবালোকে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেন, তারা হচ্ছেন নেতা। টেন্ডারবাজি করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট যারা করেন, তারা হচ্ছেন নেতা। পুলিশের, প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি দিয়ে যারা পাঁচ লাখ টাকা নেন, তারা হচ্ছেন নেতা। গরিব পিয়নের চাকরি দিয়ে তিন লাখ টাকা যারা নেন, তারা হচ্ছেন নেতা।’ বৃহত্তর নোয়াখালীতে কারা প্রকাশ্য দিবালোকে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেছেন, সে কথা সবার জানা। টেন্ডারবাজি করে কারা কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন, তাও মানুষের মুখে মুখে। এত দিন মানুষ আড়ালে-আবডালে কথাগুলো বললেও আবদুল কাদের প্রকাশ্যে বলেছেন। সত্য বলতে সাহস থাকতে হয়। সত্যবাদী যে দলেরই হোক না কেন সবসময়ই সবার কাছে সম্মানের মানুষ। নিজ দলের নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতার বিপক্ষে, অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলায় তিনি দলীয় কিছু লোকের বিরক্তির কারণ হবেন। কিন্তু সাহস করে কথা বলার জন্য তিনি আপামর বাঙালির কাছে প্রিয় মানুষের স্থান পাবেন।
কে শুনবে কার কথা!
আবদুল কাদের মির্জা কৃত্রিমতা ছাড়া ঠিক কথাই বলেছেন। কিন্তু এদেশে কে শুনবে কার কথা! বাংলাদেশের রাজনীতির তো ‘জগাখিচুড়ি’ অবস্থা। কাদের মির্জার কথাগুলো হালকাভাবে না নিয়ে গভীরে খুঁজে দেখা দরকার। সবাই এখন রাজনীতি করতে চায়। তার কারণ কী? কারণ হলো বর্তমানে রাজনীতি একটা লাভজনক ব্যবসা! এখন দেশপ্রেমের রাজনীতি কেউই করেন না। আগে সমাজের মহৎ, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষানুরাগীরা স্ব-উদ্যোগে নিজের অর্থ ও বাপের সম্পত্তির ওপর বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা হাসপাতাল গড়ে পৈতৃক সম্পত্তি নিঃশেষ করতেন। আর এখন নিঃস্বরা রাজনীতি করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়! রাজনীতিতে এখানে শুধু চামচামি আর তেল মাখাতে পারলেই বিনা পুঁজিতে সবচেয়ে বেশি লাভ! এজন্যই চাকরিরত অবস্থায় ডাক্তার, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী তাদের পেশাগত দায়িত্বের চেয়ে ক্ষমাতসীনদের দালালি, চামচামি, গলাবাজি আর টকশোতে সময় বেশি দেন। রাজনীতির জন্য বিশেষ কোনো যোগ্যতা থাকতে হয় না। ক্ষমতায় গেলেই কোনো না কোনোভাবে টাকা বানানো যায়। এভাবেই সরকারি আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে চাকরিজীবনে তারা দুর্নীতির ষোলোকলা পুরা করেন। পরিশেষে চাকরি শেষে রাজনীতিতে নেমে পড়েন। কারণ চাকরি শেষে রজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয় না পেলে অথবা বিদেশে পাড়ি না দিলে অবৈধ সম্পদের নিরাপত্তা থাকে না। এছাড়া রাজনীতি হলো পা চাটার মতো খাবার দিলেও থাকবে, লাথি মারলেও থাকবে। অর্থাৎ লেজুড়বৃত্তির রাজনীতিতে দলের প্রধানরা যা-ই বলুন, তাতেই নাচতে হবে; নিজ দলের দেশপ্রেমের দোহাই, কি সংবিধানের দোহাইসহ যে কোনো সিদ্ধান্ত নিক না কেন বলতে হবে ভালো!
সময়ের সাহসী বীর
চতুর্দিকে যখন দলকানা, মধুলোভী ও স্বার্থবাদীরা ক্ষমতাসীনদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে পালিত সরকারের (কতিপয়) কর্মকর্তাও ব্যস্ত তোষামোদিতেÑঠিক তখনই এমন কথা আগুনের মধ্যে পানি ঢালার মতো অবস্থা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই নোয়াখালী আওয়ামী লীগের নেতা ও বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা নির্বাচন, রাজনীতি, আওয়ামী লীগের এমপি ও নেতাদের সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে, যা মিথ্যার বুক চিরে সত্য মাথা তুলে প্রকাশিত হওয়ারই সূচনা বলে আমরা মনে করছি। তিনি এমন কিছু কথা বলেছেন, যা বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলের নেতারা বলতে সাহস পাননি; কিংবা বললেও ক্ষমতাসীনেরা অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দেন।
শত খারাপের মাঝেও কিছু ভালো দৃষ্টান্ত আছে। যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, আবদুল কাদের মির্জার মতো নেতাদের নাম সমুজ্জ্বল থাকবে। জনগণকে ভালোবাসলে জনগণ ভালোবাসা দেয়, জোরজবরদস্তি করে জয়ী হতে হয় না। এরকম হাজারো উদাহরণ আমাদের দেশেই আছে। আবদুল কাদের মির্জা দেশের প্রকৃত বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। একজন আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে যেখানে তাদের অধিকাংশ নেতা চাটুকারিতায় ব্যস্ত, সেখানে তার মতো সাহসী নেতা প্রত্যাশা করে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ। তার মতো মনোভাব নিয়ে যদি সব দলের সব প্রার্থী নির্বাচন করতেন, তাতে মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত হতো, গণতন্ত্র রক্ষা পেত।
ফ্রিল্যান্স লেখক
abunoman1972@gmail.com