Print Date & Time : 12 August 2025 Tuesday 1:58 pm

সন্তানের বয়ঃসন্ধিকালে মা-বাবার করণীয়

রিফাত জাফরীন: জারীফের বয়স ১৩। সেই ছোট্ট জারীফ আর নেই সে। ইদানীং প্রায়ই খুব মেজাজ করে। খিটখিটে স্বভাবের হয়েছে সে। কোনো কথাই বলা যায় না জারীফকে। সেদিন বিকালে বাসায় ফিরতেই দেখা গেল ঠোঁট কেটে-ফুলে রক্তারক্তি। কী হয়েছে জানতে চাওয়া হলে বলে, রাস্তায় নাকি পড়ে গেছে। পরে বন্ধু তারীফের মা এসে অভিযোগ করেন জারীফ নাকি তারীফের সঙ্গে মারামারি করেছে। এজন্য তারীফের হাত কেটে যাওয়ায় সেলাইও দিতে হয়েছে।
১৪ বছরের তিতিরের স্কুল থেকে একদিন মায়ের কাছে ফোন আসে এক্ষুনি স্কুলে যেতে হবে তিতিরের মা-বাবাকে। অভিযোগ গুরুতর। তিতির নাকি আরও কয়েকজন বান্ধবীকে নিয়ে স্কুলের ওয়াশরুমে সিগারেট খাচ্ছিল! তার ব্যাগ সার্চ করেও সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার পাওয়া গেছে।
ওপরের উদাহরণগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েরা এ ধরনের বহু অনাকাক্সিক্ষত কাজ করে ফেলে কখনও উদ্দেশ্যমূলকভাবে জেনে, কখনও-বা নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়ে ভুল কাজে। এ সময় তারা জ্ঞানীয় বিকাশ বা কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট এবং নৈতিকতার বিকাশ বা মর‌্যাল ডেভেলপমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো পার হতে থাকে। এভাবে ঠিক-বেঠিকের ধারাবাহিকতায় তাদের জীবন চলতে শুরু করে। তাদের ভবিষ্যৎ ব্যক্তিত্ব তৈরির জন্য এ সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ের ভুলগুলো যদি শোধরানো না যায়, তবে ভবিষ্যতে অপরাধমূলক নানা কাজে তাদের জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
বয়ঃসন্ধিকালের এ সময়টায় মা-বাবা ও শিক্ষকদের হতে হয় অনেক কৌশলী ও মানবিক। ভুলের জন্য মারধর, বকাঝকা বা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ না করে তাদের আদর করে সমমনা হয়ে বুঝিয়ে বলা কর্তব্য অভিভাবকদের।
বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীরা এক ধরনের অস্তিত্বসংকটে ভোগে। ফলে এমন কিছু কাজ তারা করে, যাতে অন্যের মনোযোগ আকর্ষিত হয়। তাদের যুক্তি তাদের বলে, স্বাভাবিক আচরণ করলে কেউ তাদের প্রতি মনোযোগী হবে না। ফলে তাদের এমন কিছু করতে হবে, যাতে অন্যরা তাদের প্রতি মনোযোগী হয়। ভুলত্রুটি করলে সবাই তাদের প্রতি মনোযোগী হয়, এ ধারণা থেকে তারা অনাকাক্সিক্ষত আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। কিশোররা এ সময় রেগে থাকে, আগ্রাসী আচরণ করে, এমনকি বীরত্ব দেখানোর জন্য আক্রমণাত্মকও হয়ে উঠতে পারে। কিশোরীরা এ সময় কপাল কুঁচকে থাকে এবং কম হাসে এই ভেবে যে, হাসলে যদি ব্যক্তিত্ব কমে যায়।
বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের শরীরে হরমোনের পরিবর্তন হয় এবং এর প্রভাবে তাদের মন ও শরীরে আবেগের ঝড় বয়ে যায়, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ অনুভূত হয়। মনোজগতে উঁকি মারে অনেক প্রশ্ন, আর এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেক সংকটে ও সংকোচে থাকে বলে মা-বাবা এমনকি অতিঘনিষ্ঠ বন্ধু ও শিক্ষককে কিছু বলতে চায় না। ফলে নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়। তারা ইন্টারনেটসহ নানা মাধ্যমে বিষয়গুলোর উত্তরের ভুল ব্যাখ্যা পায় ও ভুলভাবে বোঝে। ভুলভাবে নিজের মনের আবেগের ঝড়কে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ভুল পথে পা বাড়ানোর আশঙ্কা বেড়ে যায়।
বয়ঃসন্ধিকালে অজানাকে জানার ও নতুনকে আবিষ্কারের নেশায় এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার থেকে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে কিশোর-কিশোরীরা। সেইসঙ্গে থাকে ‘পিয়ার প্রেশার’ বা সমবয়সিদের চাপ। এ চাপের ফলে সে বন্ধুদের মনমতো আচরণ করতে চায়, দলছুট হয়ে যাওয়ার ভয়ে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। পরিবেশ ও বন্ধুরা হয়ে ওঠে তার ‘ডিসিশন মেকার’। এ সময় অনেক কিশোর-কিশোরীই অসৎসঙ্গে ভুল পথে পরিচালিত হয়ে মাদকাসক্তি কিংবা জঙ্গিবাদের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ে।
এসবের পাশাপাশি মা-বাবার আচরণ ও নৈতিকতাও সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে এ প্রভাব পড়ে অত্যন্ত প্রখরভাবে। বাবা-মা যদি মিথ্যা বলেন, সামাজিক মাধ্যম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, সামাজিক নিয়মকানুন ও আইন ভাঙেন, পারিবারিক কলহে লিপ্ত হন, আগ্রাসী আচরণ করতে থাকেন তবে সন্তানেরা ‘অবজারভেশনাল লার্নিং’-এর কারণে সে ধরনের আচরণই রপ্ত করে।
বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীরা অনেক সময় পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে কিংবা মা-বাবা ও শিক্ষকের কাছ থেকে শাস্তি পাওয়ার ভয়ে একটি ভুল ঢাকতে গিয়ে আরেকটি ভুল করে, এমনকি আরও গুরুতর ভুল পথে পা বাড়ায়।
শিশু-কিশোররা কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার নামে মানসিক রোগের কারণেও ক্রমাগত সমাজবিরোধী ভুল আচরণ অথবা বিভিন্ন অন্যায় করতে থাকে। তবে কিশোরবেলার ভুলগুলোকে ভুল হিসেবেই দেখতে হবে। এসব ভুলকে অপরাধ বিবেচনা করে শাস্তি দিতে গেলে বিপদ বাড়বে। এক্ষেত্রে শাস্তি না দিয়ে সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। মা-বাবা ও শিক্ষকদের বিষয়গুলো বুঝতে হবে। তবে মা-বাবাকেও সন্তানের কোনো অপরাধের জন্য সন্তানের পক্ষে সাফাই না গেয়ে, অন্যের ওপর দোষ না দিয়ে নিজের সন্তানকেই বিষয়টি বুঝিয়ে বলতে হবে। তাকে তার আচরণ পরিবর্তনের সুযোগ দিতে হবে। চাপ দিয়ে নয়, বরং যুক্তি দিয়ে, আদর করে, ভালোভাবে তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে।
মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের বুঝতে হবে, তাদের পাশে থাকতে হবে। কী কারণে এমন ভুল করছে, তা বোঝার চেষ্টা করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের দায়ী না করে তাদের আচরণটি যে ভুল, তা তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। সন্তানকে তিরস্কার না করে, তাকে ভুলের জন্য দায়ী না করে, ভুল আচরণ পরিবর্তনের জন্য তাকে বলতে হবে। সন্তানের ভুলের জন্য মা-বাবার একে অন্যকে দায়ী না করে সন্তানের প্রতি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পারস্পরিক দায়ী করার প্রবণতা সন্তানকে ভুল করতে উৎসাহিত করে। বেশি বকাবকি ও মারধর করলে সন্তান নেতিবাচক কাজ করার মাধ্যমেই মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য ‘রি-এনফোর্সড’ হয়। সন্তানের আচরণ পরিবর্তন চাইলে মা-বাবাকে যুক্তিযুক্ত আচরণ করতে হবে। ভুলের জন্য সন্তানকে ক্রমাগত ব্যঙ্গ না করে, তার সমালোচনা না করে তাকে ভুল শোধরাতে উৎসাহ দিতে হবে। সন্তান যেন নিজেকে অপরাধী হিসেবে শনাক্ত না করে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অপরের মত, পথ ও বিশ্বাসের প্রতি সম্মান দেওয়ার চর্চা পরিবারে থাকতে হবে। স্কুলের পরিবেশও যেন সব ধর্মের প্রতি সম্মানজনক হয়, সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। সন্তানকে সব সময় সঠিক তথ্য দিতে হবে। মা-বাবাকে সন্তানের বন্ধু হতে হবে, সন্তানকে সঙ্গ দিতে হবে এবং কোয়ালিটি সময় পার করতে হবে সন্তানের সঙ্গে মা-বাবাকে। মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের যাতে মানসিক দূরত্ব তৈরি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সন্তান অকপটে মা-বাবার সঙ্গে যেন সব শেয়ার করে, সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার এমন সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার, মাদকাসক্তি বা অন্য কোনো মানসিক রোগের কারণে যদি সন্তান ভুল আচরণ করে, তবে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। আমাদের সন্তানকে সবার আগে বুঝতে হবে আমাদেরই। বয়ঃসন্ধিকালে মা-বাবাকেই এগিয়ে আসতে হবে সন্তানের সব সংকোচ ও সংকট উত্তরণে। সন্তানের অসহায়ত্ব বুঝতে হবে মা-বাবাকেই। এগিয়ে গিয়ে মমতার হাত বাড়াতে হবে মা-বাবাকেই সবার আগে।

পিআইডি প্রবন্ধ