আলী ওসমান শেফায়েত: সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সব মা-বাবাই চিন্তামগ্ন থাকেন। কিন্তু আমার মনে হয় সন্তানের ভবিষ্যতের চেয়ে আজকালকার মা-বাবারা নিজেদের কথাই বেশি ভাবেন। যদিও আমি জানি এবং বিশ্বাস করি আমার এই কথার সঙ্গে এ দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষই একমত হতে পারবেন না। আজকালকার মা-বাবারা সন্তানকে নামি-দামি স্কুল, সেরা শিক্ষকের কাছে পড়াতে পিছপা হন না। তার একমাত্র কারণ কিন্তু সন্তানের ভবিষ্যৎ নয়; এর পেছনে আরও অনেক কারণ আছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সমাজে নিজেদের স্ট্যাটাস ঠিক রাখা। যেন পাশের বাসার ভাবি বলতে না পারেন আমার বাচ্চা দেশসেরা স্কুলে পড়ে, আপনার বাচ্চা কোথায় পড়ে?
এর বাইরে আরও যে কারণগুলো আছে তা হলো সেরা স্কুল-কলেজে পড়লে বাচ্চার ভবিষ্যৎ বেশি উজ্জ্বল হবে। ফলে সে ভালো ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে বেশি বেতনের চাকরি করবে। বৃদ্ধ বয়সে তারা সন্তানের সঙ্গে খুব আরাম-আয়ে?শে দিন কাটাতে পারবেন। এ কারণেই কোনো কোনো মা-বাবা সন্তানের নিজস্ব স্বপ্নকে গলাটিপে হত্যা করেন, তার ওপর চাপিয়ে দেন নিজেদের অপূরণীয় স্বপ্ন। হয়তো মা-বাবা নিজেরা ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি। এখন তারা স্বপ্ন দেখেন তাদের সন্তান ডাক্তার হবে। সে অনুযায়ী নানাভাবে সন্তানকে চাপ দিতে থাকেন। ফলে সন্তানের ইঞ্জিনিয়ার বা ক্রিকেটার বা শিক্ষক যা হওয়ার স্বপ্ন ছিল, তা নিমিষেই মাটিতে চাপা পড়ে যায়। এভাবে না জানি এ দেশের কত ছেলেমেয়ের নিজের স্বপ্ন নিজের অজান্তেই কোরবানি হয়ে গেছে। আমি যা বলছি এটা একান্তই আমার ভাবনা থেকে বলছি। আমি বিশ্বাস করি, এই কথার সঙ্গে অধিকাংশ অভিভাবকই একমত হবেন না।
বাংলাদেশের সেসব অভিভাবকের কাছে আমার প্রশ্নÑযারা সন্তানদের দেশসেরা স্কুল-কলেজে ভর্তি করানোর জন্য সকাল-সন্ধ্যা সন্তানের ওপর বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছেন এবং মোটা অঙ্কের ডোনেশন দিচ্ছেন। আপনারা কি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন, যদি নামি-দামি সেসব স্কুলে বাচ্চাকে ভর্তি করানোর পরও সেই বাচ্চাকে সেই স্কুলের স্যারদের কাছে কিংবা অন্য কোনো স্যার বা কোচিংয়ে প্রাইভেট পড়াতে হবে না? যদি আপনার উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে নামি-দামি স্কুলে ভর্তি করে লাভ কি? হ্যাঁ, এটা আমি অবশ্যই বিশ্বাস করি যে, ভালো স্কুলের পরিবেশ ভালো হয় এবং পড়াশোনার মানও তুলনামূলক অনেক ভালো হয়। তার মানে এই নয় যে, অপেক্ষাকৃত সাধারণ মানের স্কুলের ছেলেমেয়েরা কিছুই শেখে না এবং জীবনে কিছুই হতে পারে না।
আমার পরামর্শ হচ্ছে, যে টাকা আপনার বাচ্চাকে নামি-দামি স্কুলে ভর্তির জন্য খরচ করছেন কিংবা ডোনেশন দিচ্ছেন কিংবা কোচিং-প্রাইভেটে খরচ করছেন সেই টাকা আপনার হাতে রাখুন। বাচ্চাকে বাসার আশপাশের সাধারণ কোনো স্কুলে ভর্তি করান। তারপর সেই হাতে রাখা টাকাগুলো বাচ্চার পড়াশোনার এবং সার্বিক কল্যাণের জন্য খরচ করুন। দেখবেন আপনার বাচ্চা অনেক নামি-দামি স্কুলের সেরা ছাত্রছাত্রীর চেয়ে কোনো অংশেই খারাপ রেজাল্ট করবে না। বরং তার ওপর প্রেসার কম থাকায় সে বরং পড়াশোনার পাশাপাশি কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিসগুলোতেও ভালো করবে। তাদের শৈশব-কৈশোর হারিয়ে যাবে না। এখান থেকে ওখানে কিংবা ওখান থেকে এখানে যাওয়া-আসা করে যে সময় নষ্ট হয় সেই সময়টাও সে কাজে লাগাতে পারবে।
মূল কথা হচ্ছে, ভালো স্কুলে ভর্তির জন্য যদি এতই দৌড়ঝাঁপ করবেন তাহলে কেন বাচ্চাকে ধর্ম কিংবা শারীরিক শিক্ষার মতো সাধারণ বিষয়ও স্কুলেরই টিচারের বাসায় প্রাইভেট পড়তে যেতে হবে? তাহলে ভালো স্কুল, নামি-দামি স্কুল আপনার বাচ্চাকে কি দিচ্ছে? সেই স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য কেন এত উঠে-পড়ে লেগেছেন? আপনি কি জানেন! আপনি নিজেই আপনার সন্তানের মেধাকে, আপনার সন্তানের সুন্দর শৈশব-কৈশোরকে ধ্বংস কর দিচ্ছেন? কোচিং-প্রাইভেটে যদি যেতেই হয় তাহলে নামি-দামি স্কুল আর ঘরের পাশের সাধারণ স্কুলের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
বুয়েট, মেডিকেল, ঢাকা ইউনিভার্সিটি বা অন্য যে কোনো ইউনিভার্সিটিতে যে কোনো বিভাগে গিয়ে আমরা যদি একটিবার খোঁজ নিয়ে দেখতামÑকে কোন্ স্কুল থেকে পড়ে এসেছে, তাহলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যেত। অবাক হয় তখনই, যখন জানতে পারি অধিকাংশই গ্রাম থেকে, মফস্বল শহর থেকে এসেছে। অখ্যাত কোনো গ্রামের সাধারণ স্কুল-কলেজ থেকে পাস করে আসা ছাত্রছাত্রীরা যে হারে বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেলে চান্স পাচ্ছে এই শহরের নামি-দামি স্কুল-কলেজ থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রীরা আনুপাতিকভাবে সেই হারে চান্স পাচ্ছে না। সাধারণ স্কুলের ছাত্রছাত্রীটির জন্য যা ব্যয় হয়েছে তার দশগুণ ব্যয় হচ্ছে শহরের ছাত্রছাত্রীর জন্য; বিশেষ করে ভালো মানের স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য। এই যে ব্যয় হচ্ছে এটা তৈরি করেছি আমরা নিজেরা, অভিভাবকরা।
আমরা মনে করছি ভালো স্কুল-কলেজে ভর্তি না করলে আমাদের সন্তানরা ভালো মানুষ হতে পারবে না, প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বেরিয়ে আসুন আপনাদের দিবাস্বপ্ন থেকে। বাস্তবতা বুঝতে চেষ্টা করুন। এখন চলছে শিক্ষাবাণিজ্য। যে যা-ই বলুক না কেন, নিজ থেকে একটু চিন্তা করে দেখি! তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। এসব শিক্ষাবাণিজ্যের বিরুদ্ধে এখনই সোচ্চার হোন। নতুবা আপনার-আমার সন্তান, ভাই-বোন কাগজে-কলমে ভালো রেজাল্টধারী হবে কিন্তু বাস্তব জীবনে সে কী হবে সেটা সময়ই বলে দেবে।
প্রাইভেট এবং কোচিং যেখানে করতেই হচ্ছে সেখানে নামি-দামি স্কুলে পড়ানো আর না পড়ানো সমান কথা। আমি আবারও বলতে চাই নামি-দামি স্কুলের পরিবেশ অনেক ভালো এবং পড়াশোনার মানও অনেক অনেক ভালো কিন্তু ওইসব প্রতিষ্ঠান একই সঙ্গে আপনার সন্তানের ওপর নানা প্রেসার তৈরি করছে এবং সঙ্গে সঙ্গে আপনার পকেট খালি করছে। প্রতিনিয়ত চলছে ক্লাস টেস্ট এটা-সেটা আরও কত নামে-বেনামে টেস্ট। সেগুলো ফুলফিল করতে গিয়ে আপনার আমার সন্তানরা হাঁপিয়ে উঠছে। পাশ থেকে আমরা বাতাস করছি আর বলছি এই তো আর একটু চেষ্টা করো দেখবে তুমি সেরা হয়ে যাবে। আমিও মেনে নিচ্ছি ক্লাসটেস্ট এটা-সেটা টেস্ট নিলে মেধা শানিত হয়। কিন্তু সন্তানের মনের মধ্যে একা একা যে লড়াই চলেছে তার খবর আমরা কেউ রাখি না। ক’দিন আগে যে বোনটি ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পায়নি বলে আত্মহত্যা করেছে তার জন্য আমি আপনি সবাই কি দায়ী নই? ভর্তি পরীক্ষায় চান্স না পাওয়া মানেই জীবনের শেষ নয়, এটা তাকে আমরা শেখাইনি বরং তাকে শিখিয়েছি ভর্তি পরীক্ষায় চান্স না পাওয়া মানেই তোমার জীবন ব্যর্থ। ফলে আমাদের বোন, আমাদের সন্তান বোঝা বয়ে বয়ে ক্লান্ত হয়ে জীবনকেই ছুটি দিয়ে দিচ্ছে।
প্রতিযোগিতার এই বিশ্বে কাউকে না কাউকে হারতেই হবে কিন্তু একবার হার মানেই জীবন শেষ নয়, এই শিক্ষাটা আমরা কেউ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজš§কে দিচ্ছি না। ফলে স্বপ্নগুলো মরে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদেরই উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় কোনো কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী। অনুরোধ, মিছে ভ্রমের পেছনে ছুটবেন না। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা যদি চিন্তা করতেই হয়; তবে ভেবে দেখুন আপনি ভুল পথেই এগোচ্ছেন।
মুক্ত লেখক