মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: বিপদ যেন পিছু ছাড়ছে না যশোরের চাষিদের। গত তিন মাসে বেশ কয়েকবার ভারী বৃষ্টিপাতে তিন দফা শীতকালীন আগাম সবজির ক্ষতি হয়। এরপর কৃষক যখন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ফের সবজি রোপণ শুরু শুরু করে ঠিক সেই মুহূর্তে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র প্রভাবে ফের বৃষ্টি শুরু হয়েছে যশোর অঞ্চলে। বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জেলায় ১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। শুক্রবারও থেমে থেমে বৃষ্টি চলছে। এটি রাতে আরও জোরদার হতে পারে বলে আবহাওয়া অফিস বলছে।
এদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে যখন এই অঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হয়েছে ঠিক তখনি যশোরের বিস্তীর্ণ মাঠে রয়েছে আধাপাকা আমন ধান। প্রতিটি ক্ষেতেই ধানের শীষ দোল খাচ্ছে। কৃষি বিভাগের মতে, এ বছর প্রলম্বিত বৃষ্টির প্রভাব বেশি হলেও অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার জমির কিছু ধান পানিতে তলিয়ে গেলেও অবশিষ্ট অধিকাংশ আমন ক্ষেতে বাম্পার ফলনের আশা রয়েছে। তবে চলমান ঝড় ও বৃষ্টির কারণে এসব ধানক্ষেতে ক্ষতির আশঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ। ফলে সবজির পাশাপাশি আমন ধানের ক্ষতিরও আশঙ্কা জোরালো হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
যশোর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মতিউর রহমান বিমান ঘাঁটি নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে বৃহস্পতিবার ভোর থেকে যশোরে বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে, যা শুক্রবার দিনভর গুঁড়ি গুুঁড়ি আবার কখনও তা একটু জোরালো অবস্থায় বিরাজমান ছিল। তবে তা মধ্যরাত থেকে তা বেড়ে ভারী বৃষ্টিপাতে রূপ নেয়ার সম্ভাবনা আছে বলে আবহাওয়া অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন। তবে যশোরাঞ্চলে এর প্রবল প্রভাব পড়বে না বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
এদিকে সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতে ফের বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়ে সবজি ও আমন চাষিরা রীতিমতো টেনশন করছেন। যশোর সদর উপজেলার তীরের হাট গ্রামের সবজিচাষি আবু বকর বলেন, এবছর ঝড়-বৃষ্টি তাদের যেন পিছু ছাড়ছে না। তিনি বলেন, সবজি চাষের উপযুক্ত মৌসুমে প্রথমে অনাবৃষ্টির কবলে পড়ি। এরপর সেচ দিয়ে যখন সবজিক্ষেতে পরিচর্যা করতে থাকি তখন গত দেড় মাসের ব্যবধানে তিন দফা বৃষ্টিতে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে আমাদের। এর প্রধান কারণই হচ্ছে অতিমাত্রার বৃষ্টিপাত। তিনি বলেন, তিন দফা ক্ষতির পর আমরা চতুর্থ দফায় যখন সবজির চারা রোপণ শুরু করেছি, ঠিক তখনই ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে আবার বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। এই বৃষ্টিতে যেসব বীজের চারা গজায়নি, সেগুলো নিশ্চিত নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে আমাদের আর কোনো উপায় থাকবে না।
একইভাবে আশঙ্কা করেন বাঘারপাড়ার রায়পুর গ্রামের আমন চাষি শামছুর রহমান। তিনি বলেন, এ বছর ভারী বৃষ্টিতে নিচু এলাকার আমন ক্ষেত তলিয়ে গেলেও অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে আমনের বাম্পার ফলনের আশা রয়েছে। প্রতিটি ক্ষেতের ধানক্ষেতে ইতোমধ্যে শীষ গজিয়ে গেছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেতে ধানের শীষ সবেমাত্র বের হচ্ছে। এ অবস্থায় বৃষ্টির সঙ্গে ঝড় হলে এসব ধানক্ষেতের মারাত্মক ক্ষতি হবে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।
যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক, ড. সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, যশোরে চলতি বছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। এতে এ অঞ্চলের শীতকালীন আগাম সবজি চাষ পিছিয়ে আছে। তিনি বলেন, উল্লেখ করার মতো বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত ২৫ আগস্ট রাত ৯টা থেকে পরদিন ২৬ আগস্ট সোমবার সকাল ১০টা পর্যন্ত জেলায় ২২৮ মিলিমিটার। এর আগে ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর তিন দিনে এই জেলায় বৃষ্টি হয়েছিল ২১৩ মিলিমিটার। এর বাইরেও আরও বিভিন্ন দফা বৃষ্টিপাত হয়। আর সর্বশেষ গত ১৭ অক্টোবর ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে বৃষ্টিপাত রেকর্ড ১১৭ মিলিমিটার। এসব বৃষ্টিতে এ অঞ্চলের আগাম শীতকালীন সবজির বেশি ক্ষতি হয়েছে। আর নিচু এলাকার আমনের ক্ষতি হয় ৬৫০ হেক্টর জমি। তবে অবশিষ্ট ১ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমির ধানে বরং আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়।
ড. সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাব কতটা এ অঞ্চলে পড়বে সেটি দেখার বিষয়। আমাদের ভয় লাগছে ঝড়ের তীব্রতা বেশি না হয়। যদি এ আশঙ্কা সত্যি হয় তাহলে ‘পাকা ধানে মই, দেয়ার উপক্রম হতে পারে। তিনি বলেন, ভারী বৃষ্টিপাত না হলে ধানের ক্ষতির চেয়ে উপকার বেশি হবে। তবে সেক্ষেত্রে ঝোড়ো হাওয়া হলে ধানের পরাগায়ন কম হওয়ার পাশাপাশি ধানের গাছ মাটিতে নুয়ে পড়তে পারে। এতে পানিতে আমন আবাদ নষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
পাশাপাশি সবজি ক্ষেতেরও বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে।