সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করাই বড় চ্যালেঞ্জ

মেজবাহ হোসেন: জায়েদা খাতুন বেসরকারি ফলাফলের ভিত্তিতে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র। যেহেতু প্রধান প্রতিপক্ষ আজমত উল্লা নির্বাচনের ফল মেনে নিয়েছেন, তার দলেরও একই মত, তাই বলা যায় জায়েদা খাতুনই পরবর্তী মেয়র।

মেয়র পরিচয়ের বাইরে তিনি খুব সম্ভবত সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা হিসেবেই বেশি পরিচিত হবেন আগামী দিনগুলোয়ও। এর অবশ্য খুব যৌক্তিক ভিত্তি আছে। যতটুকু জানা গেছে, জায়েদা খাতুনের এর আগে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না, সাদাসিধে একজন গৃহিণী থেকে ছেলের হাত ধরে রাজনীতির মাঠে এসে প্রথম ম্যাচেই গোল দিলেন। বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে এই বয়সে (৭০) তিনি ছেলের সম্মান রক্ষা ও ছেলের প্রতি সরকারের অন্যায্য সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে যে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন সেটি নিঃসন্দেহে অভাবনীয়। মামলা, হামলা, গুম বা সম্ভাব্য সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এবং সব থেকে বড় কথা শেখ হাসিনার মতো একজন আয়রন লেডির সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যেই অসম্ভব সাহসিকতার পরিচয় তিনি দিয়েছেন তা বর্তমানে বিরল। এটাই মা-সন্তানের সম্পর্ক; সন্তানের জান-মান বাঁচাতে মায়েরা বোধহয় এভাবেই বাঘিনীর সঙ্গেও লড়াইয়ে লিপ্ত হতে দুইবার ভাবে না। ২০১৮ সালে জাহাঙ্গীর আলম সরকার বা দলের কতটুকু আনুকূল্য পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন সেটা নিয়ে আজ কথা বলব না; তবে এটা বলা হয়তো ভুল হবে না যে, সেই নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি অনেকটা নিখুঁতভাবে খেলতে পেরেছে। সরকার বা দল কি করে বা করতে পারে সেই ধারণা থেকেই তিনি গুম হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করা ও দূতাবাসগুলোতে চিঠি দিয়ে শঙ্কার কথা জানাতে পেরেছেন। ২০১৮-এর নির্বাচনে যেহেতু দুই লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন বিএনপি প্রার্থীর বিপরীতে তাই সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা সহজেই অনুমেয়। তবে এবারের  নির্বাচনে তিনি প্রকৃত বিজয়ের স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছেন বলে অনুমান করি। অবশ্য দেশের বোদ্ধা মহল এই বিজয়ের কৃতিত্ব অনেকটা মার্কিন দূতাবাসকে দিতে আগ্রহী; কারণ মার্কিন দূত আমেরিকার নতুন ভিসানীতির কথা অনানুষ্ঠানিকভাবে সরকারকে বেশ কিছুদিন আগে জানালেও সেটি প্রকাশ করা হয়নি, তাই দূত নিজেই বিষয়টি টুইট করে জানান দেন আর এভাবেই নির্বাচনী ষড়যন্ত্রের লাগাম টেনে ধরেন। নতুবা বিভিন্ন ধাপে ভোট গণনায় জায়েদা খাতুন এগিয়ে থাকলেও খুব চেনা ভঙ্গিতেই শেষের দিকে সামান্য ব্যবধানে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী  ঘোষণা করা হতো আর বলা হতো নির্বাচন সুষ্ঠু ও তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়েছে।

এই নির্বাচনটি গাজীপুরের হলেও এবং বিএনপি অংশ না নিলেও দেশবাসীর কাছে এটি বেশ আগ্রহের বিষয় ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলম কতটুকু জনগণের ফোকাসে ছিল সেটি নিশ্চিত না হলেও এবারের নির্বাচনে যে পদচ্যুত মেয়র জনগণের পূর্ণ ফোকাস ও আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল এই বিজয়ই তার বড় প্রমাণ। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনের সময়েও পুরো দেশ একইভাবে নির্বাচনী শীতলতা অনুভব করেছিল। পছন্দের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে যেই দলের বিরুদ্ধে হেলিকপ্টারে করে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা, নির্বাচনের আগে ব্যাপক জনপ্রিয় প্রার্থীকে গুম করা এবং দিনের ভোট রাতে করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে  তারা হয়তো মার্কিন চাপে এবার তেমন কিছু করেনি কিন্তু পরাজয়ের ব্যবধানকে যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে কোনো ভূমিকা পালন করেনি তার নিশ্চয়তা কি?

গাজীপুরের মানুষ কেন জাহাঙ্গীরের মাকে ভোট দিল? যদিও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটি স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন কিন্তু গাজীপুরে কেবল স্থানীয় লোকজন বসবাস করে এমন নয়। বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও গার্মেন্টস অধ্যুষিত এই এলাকা যেমন রাজধানীর খুব কাছে, তেমনি সারাদেশ থেকে আগত অনেক মানুষ সেখানে বাস করে জীবিকার তাগিদে। রাজধানীর পরপরই গাজীপুর বৃহত্তর একটি শিল্প ও অর্থনৈতিক অঞ্চল। সরকার কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই নির্বাহী সিদ্ধান্তে মধ্যরাতে যখন সকল প্রকার জ্বালানির দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ায় তখন এর উত্তাপ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লেও ঢাকা ও গাজীপুরে এর প্রভাব সব থেকে বেশি অনুভূত হয় সঙ্গত কারণেই। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন যাত্রার ব্যয়, দ্রব্য মূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি, উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধি মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এই বিরাট ও মিশ্রিত জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম ও রায় যে পুরো দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে তাতে কোনো সন্দেহ  নেই। তাই জনগণ সরকারের বিপক্ষে দাঁড়ানোর মতো যে কেউ একজনকেই তার প্রতিনিধি হিসেবে ধরে নিয়ে এই ভোট যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। কারণ খুব সম্প্রতি কোনো নির্বাচনেই এত বিপুল ভোটারের উপস্থিতি চোখে পড়েনি। গাসিক ও নাসিক নির্বাচনে দেখা গেল যে এই কেউ একজন আসলে নিজেও একজন আওয়ামী লীগ, তবে সরকারের বাইরের আওয়ামী লীগÑমানে বেসরকারি আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের বিপক্ষে অন্যদল বা প্রকৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হলে সেটি গণতন্ত্রের চর্চা বলেই গণ্য হতো কিন্তু সরকারি আওয়ামী লীগের বিপক্ষে বেসরকারি আওয়ামী লীগকেই যখন মানুষ বেছে নেয় তখন সরকারের প্রতি মানুষের ক্ষোভ, বিরক্তি বা অসহায়ত্ব যে কত গভীর তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

জাহাঙ্গীর আলম যদিও বলেছেন যে নৌকার জয় হয়েছে, ব্যক্তি পরাজিত হয়েছে! তিনি তার ভোটারদের প্রতি এভাবে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলেও পারতেন; কারণ কোনো পার আওয়ামী লীগার তার মাকে ভোট দেয়নি, ভোট দিয়েছে বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগার, বিএনপি জামাতের অনুসারী ও রাজনীতি না করা সাধারণ ভোটার। যাই হোক, রাজনীতি করলে সব কুল ঠিক রাখার জন্য বোধহয় এমন অশোভন আচরণ একটু করতেই হয়। প্রকৃত পক্ষে নৌকা ও শেখ হাসিনা পরাজিত হয়েছে ব্যক্তি জাহাঙ্গীরের কাছে, কে জানে মানুষ হয়তো তার ফাঁস হওয়া সেই অডিওকেই সমর্থন করে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু এই বিজয়ের স্বাদ বা তৃপ্তি ২০১৮-এর থেকে অনেক বেশি ও নির্ভেজাল তাই নগরবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ থেকে মা মেয়রের নেতৃত্বে ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের দায়িত্ব হবে গাজীপুরের সকল সিন্ডিকেট, তোলাবাজি, চাঁদাবাজি কঠিন হাতে দমন করা, দুর্নীতি নিবৃত্ত করা, জনগণের দুয়ারে গিয়ে সম্ভবপরভাবে সেবা দেয়া, গাজীপুরকে একটি দূষণ ও যানজটমুক্ত নগরীতে পরিণত করতে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তবেই হয়তো তিনি এবং তার মা গাজীপুরবাসীর এই ঋণ কিছুটা শোধ করতে পারবেন।

আরও যে একটি বিষয় আরও একবার প্রমাণিত হলো সেটি হচ্ছে আবোলতাবোল ইভিএমের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা। একটি সিটি করপোরেশনের ভোট গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশে ইভিএম মেশিন যেভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, সেখানে জাতীয় নির্বাচনে সারাদেশের হাজার হাজার ভোট কেন্দ্রে যে ভয়াবহ রকম নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে এবং ব্যক্তি বিশেষের আদেশে আদিষ্ট হয়ে মাঝরাতে ইভিএম কাল্পনিক ফল প্রসব করবে সেটি নিয়ে খুব একটা দ্বিধা নেই। তাই অবিলম্বে সকল পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে নির্দলীয় ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির কাছে নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব হস্তান্তর করে স্বচ্ছ ব্যালট পেপারে সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করাই বর্তমান সময়ে জাতির সামনে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।  

শিক্ষক, রসায়ন বিভাগ, হাবিপ্রবি

(বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত)

mezbahhossain15@gmail.com