কাজী সালমা সুলতানা:
‘সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রহ্মপুত্রে মেশে।
নূরলদীনেরও কথা যেন সারা দেশে
পাহাড়ি ঢলের মতো নেমে এসে সমস্ত ভাসায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?’
‘ভারতের কৃষকবিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ গ্রন্থে সুপ্রকাশ রায় এবং সুধাংশু পাত্র ‘বাংলার বীর বিদ্রোহী’ বইতে এই বীর বিদ্রোহীকে চিহ্নিত করেছেন নূরলদীন নামে। অন্যদিকে সব্যসাচী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক তার বিখ্যাত নাটক ‘নূরলদীনের সারাজীবন’-এ নূরুলউদ্দিনকে আখ্যায়িত করেছেন নূরলদীন নামে। এ দেশের মানুষ নূরুলউদ্দিনকে না চিনলেও নূরলদীনের কথা জানে সেটা সৈয়দ হকের ঐতিহাসিক নাটক নূরলদীনের সারাজীবন, যা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত।
সব্যসাচী লেখক হিসেবে বাংলা সাহিত্যজগতে এককথায় সৈয়দ শামসুল হকের পরিচয়। তিনি কবি, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, কাহিনীকার, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও সংস্কৃতির ধারক। মুক্তিযুদ্ধের ওপর তার নাটক বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রায় ৬০ বছর ধরে সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় সমান পারদর্শিতায় নিবেদিত এই লেখক সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে মেধা-কল্পনা-সৌন্দর্যের যে সৌধ গড়েছেন, তা আসামান্য, বাঙালির চিরস্নিগ্ধ এক বাতিঘর।
সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মায়ের আট সন্তানের জ্যেষ্ঠতম ছিলেন তিনি। সৈয়দ হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। বাবার ইচ্ছা ছিল সৈয়দ শামসুল হককে ডাক্তারি পড়াবেন। বাবার ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে সৈয়দ হক ১৯৫১ সালে বোম্বে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি এক সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৫২ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে জগন্নাথ কলেজে মানবিক শাখায় ভর্তি হন এবং কলেজজীবন শেষ করে ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। স্নাতক পাসের আগেই ১৯৫৬ সালে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর তার প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’ প্রকাশিত হয়।
বাবা মারা যাওয়ার পর সৈয়দ হক অর্থকষ্টে পড়েন। এ সময় তিনি চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি মাটির পাহাড় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখেন। পরে ‘তোমার আমার’, ‘শীত বিকেল’, ‘কাচকাটা হীরে’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘পুরস্কার’সহ আরও বেশ কিছু চলচ্চিত্রের কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখেন। ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ও ‘পুরস্কার’ এ দুটি চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে সৈয়দ হক দেশ ত্যাগ করে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে বিবিসির বাংলা খবর পাঠক হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন। তিনি বিবিসিতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটি পাঠ করেছিলেন। তিনি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বিবিসি বাংলার প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার দৃঢ়কণ্ঠ সাবলীল উচ্চারণের জন্য তিনি জনসাধারণ্যে পরিচিতি লাভ করেন।
সৈয়দ শামসুল হক প্রথম পদ রচনা করেন ১১-১২ বছর বয়সে। টাইফয়েডে শয্যাশায়ী কবি তার বাড়ির রান্নাঘরের পাশে শজনে গাছে একটি লাল টুকটুকে পাখি দেখে দু’লাইনের একটি পদ ‘আমার ঘরে জানালার পাশে গাছ রহিয়াছে/তাহার উপরে দুটি লাল পাখি বসিয়া আছে’ রচনা করেন। এরপর ১৯৪৯-৫০ সালের দিকে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে ২০০টির মতো কবিতা রচনা করেন।
সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের মে মাসে। ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায়। সেখানে ‘উদয়াস্ত’ নামে তার একটি গল্প ছাপা হয়। সৈয়দ হকের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’ ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়। পরে বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা, পরানের গহীন ভেতর, নাভিমূলে ভস্মাধার, আমার শহর ঢাকা, বেজান শহরের জন্য কেরাম, বৃষ্টি ও জলের কবিতা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ তাকে পাঠকমহলে জনপ্রিয় করে তোলে। সৈয়দ হক মৃত্যুর আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জš§দিন উপলক্ষে তার শেষ কবিতা লেখেন। কবিতার নাম ‘আহা, আজ কী আনন্দ অপার!’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৫৬ সালে প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’ প্রকাশিত হয়। তার রচিত এক মহিলার ছবি (১৯৬১), অনুপম দিন (১৯৬২), সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪) উপন্যাসগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে। ষাটের দশকে তার রচিত উপন্যাসগুলো পূর্বাণী পত্রিকার ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হতো। তার রচিত ‘খেলারাম খেলে যা’ উপন্যাসটি আলোচিত-সমালোচিত হয়।
সৈয়দ হক নাট্যকার হিসেবে সফলতা পেয়েছেন। বিবিসি বাংলায় নাটকে কাজ করার মাধ্যমে তিনি নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি পান। তার ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত একটি কাব্যনাটক। তার পরের নাটক ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ ফকিরবিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত। সৈয়দ হক তার রচনায় সমসাময়িক বাংলাদেশ এবং মধ্যবিত্ত সমাজের আবেগ-অনুভূতি ও ভালো-মন্দ দিকগুলো তুলে ধরেন। তার অন্যান্য নাটক ‘নারীগণ’, ‘যুদ্ধ এবং যোদ্ধা’, ‘ঈর্ষা’ ও ‘এখানে এখন’-এ সমকালীন বাস্তবতা ফুটে উঠেছে।
গত ২০১৬ সালের এই দিনে কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি চিরবিদায় নিয়েছেন। তার প্রয়াণে বাংলা সাহিত্যের যে নক্ষত্রের পতন হয়েছে, যা হয়তো পূরণীয় নয়। কিন্তু তিনি ভবিষ্যৎ লেখকদের-কবিদের-নাট্যকারদের অনুপ্রাণিত করবেন, পথ দেখাবেন যুগ যুগ ধরে। বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক।
গণমাধ্যমকর্মী
salma15august@gmail.com