ইসমাইল আলী: অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ২০০৯ সাল থেকে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয় সরকার। এতে বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার মেগাওয়াট। যদিও সর্বোচ্চ ১৪-১৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করা হচ্ছে। ফলে লোডশেডিং চরম আকার ধারণ করেছে। আবার লোকসানি বিদ্যুৎ খাতে প্রতি বছর বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে। পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বিভিন্ন সংস্থার গৃহীত ঋণের জন্য সরকারের সভরেন গ্যারান্টিও দ্রুত বাড়ছে।
তথ্যমতে, গত ১৪ বছরে সরকারি-বেসরকারি খাতে ১০০-র বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিভিন্ন কেন্দ্রের জন্য নেয়া হয়েছে কঠিন শর্তের ঋণ। আর এসব ঋণের জন্যও দিয়েছে সভরেন গ্যারান্টি। বর্তমানে এর পরিমাণ প্রায় ৫১ হাজার ৪৯৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা. যা সরকারের মোট সভরেন গ্যারান্টির ৫২ শতাংশের বেশি।
গত কয়েক বছরের বাজেটের সংক্ষিপ্তসার বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, বর্তমানে সরকারের সভরেন গ্যারান্টির পরিমাণ ৯৮ হাজার ৫৯১ কোটি ২৯ লাখ টাকা, গত অর্থবছর যা ছিল ৯২ হাজার ৬০১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ওই বছর বিদ্যুৎ খাতে সভরেন গ্যারান্টি ছিল ৪৯ হাজার ৫১৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারের সভরেন গ্যারান্টি ছিল ৭৩ হাজার ৮৩৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা আর ২০১৯-২০ অর্থবছর ছিল ৬০ হাজার ৬৫৩ কোটি সাত লাখ টাকা। ওই দুই অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে সভরেন গ্যারান্টি ছিল যথাক্রমে ৪১ হাজার ৬৯২ কোটি ২২ লাখ টাকা ও ৩৩ হাজার ৭৪১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
এদিকে জ্বালানি তেল আমদানিকারক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বিভিন্ন দেশ থেকে কঠিন শর্তের ঋণে তেল আমদানি করে থাকে। এজন্যও সরকারকে সভরেন গ্যারান্টি দিতে হয়। বর্তমানে এর পরিমাণ চার হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও এর পরিমাণ ছিল এক হাজার ১৯৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের বর্তমান সভরেন গ্যারান্টির পরিমাণ ৫৬ হাজার ৪২৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছর যা ছিল ৩৪ হাজার ৯৪০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
অর্থ বিভাগের মতে, সরকার বিভিন্ন সময়ে সরকারি নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের স্বার্থে সরকারি মালিকানাধীন আর্থিক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গৃহীত ঋণের জন্য গ্যারান্টি ও কাউন্টার গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। এ সমস্ত ঋণের অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সময়মতো পরিশোধ করতে না পারলে তা পরিশোধের দায় সরকারের। তাই সরকারের ভবিষ্যৎ আর্থিক অবস্থার ওপর এর প্রভাব রয়েছে। তবে সভরেন গ্যারান্টিজনিত আর্থিক ঝুঁকি কমাতে এ-সংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধন করতে চাইছে সরকার।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সভরেন গ্যারান্টি সরকারের আর্থিক ক্ষমতার ওপর চাপ তৈরি করে। আর বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাই বর্তমানে লোকসানে রয়েছে। তাই এসব প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সরকারের কাঁধেই এ ঋণ পরিশোধের দায় চাপবে। এছাড়া বর্তমানে চাহিদার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। তাই অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ করে সরকারের সভরেন গ্যারান্টি তথা আর্থিক চাপ কমানো উচিত।
তথ্যমতে, অন্যান্য খাতের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কৃষিঋণ বিতরণের জন্য বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) সভরেন গ্যারান্টি দিয়েছে সরকার। কৃষি খাতে এ গ্যারান্টির পরিমাণ তিন হাজার ৩৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে কৃষি ব্যাংকের এক হাজার ৫৬৪ কোটি তিন লাখ টাকা এবং রাকাবের এক হাজার ৪৭৫ কোটি ২০ লাখ টাকা।
একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়ে ঋণ বিতরণের জন্য কর্মসংস্থান ব্যাংককে সভরেন গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে এক হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এছাড়া পণ্য আমদানির জন্য টিসিবিকে দেয়া গ্যারান্টির পরিমাণ দুই হাজার ৯৪৪ কোটি ২০ লাখ টাকা, বিএডিসিকে দেয়া গ্যারান্টি ১৩ হাজার ১৬৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, আনসার ভিডিপি ব্যাংককে ৭৫০ কোটি টাকা ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে ২৫০ কোটি টাকা। এগুলো সবই দেশের অভ্যন্তরীণ দায়।
এদিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে দেয়া গ্যারান্টির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৫৪৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্পে ৮৯১ কোটি ৯২ লাখ টাকা, ঘোড়াশাল সার কারখানাকে এক হাজার ৫৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা, সার আমদানির জন্য বিএসইসিকে ৯ হাজার ৫৫৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনকে ১২১ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং বিজেএমসিকে ৪৯১ কোটি ৩২ লাখ টাকা।