Print Date & Time : 11 September 2025 Thursday 4:20 am

সমন্বিত প্রচেষ্টায় বন্যা মোকাবিলা করি

কাজী সালমা সুলতানা: কাল রাতে মেয়ে বলল, ‘আম্মু তুমি কি ২ হাজার ৫০০ লিটার খাবার পানি জোগাড় করে দিতে পারবা। সিলেটে খাবার পানির খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি ওকে বললাম চেষ্টা করি। এবার সিলেট-সুনামগঞ্জের বাসিন্দারা এত ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখি। এতটা খারাপ অবস্থা শেষ কবে হয়েছে জানি না। আমার শ্বশুরবাড়ি সুনামগঞ্জ শাহারপাড়া গ্রামে। সেখানে বাড়িতে কখনও পানি উঠেছে শুনিনি। ১৯৮৮ সালে প্রথম সুনামগঞ্জে যাই। তখন জুলাই মাস ছিল। নৌকা দিয়ে গিয়েছিলাম। শুনেছি সেখানে প্রতি বছর বন্যা হয়। তবে গত অনেক বছর ধরে তেমন বন্যার পানি জমা, মানুষের সীমাহীন কষ্ট এসব দেখতে হয়নি।

গত দুই দশকের বেশি সময় হবে সেখানকার ছোট ছোট খাল-বিল ভরাট হয়ে গেছে। বাড়ি হয়েছে প্রচুর, লোকসংখ্যাও বেড়েছে, তৈরি হয়েছে নতুন নতুন রাস্তা। বিদ্যুৎ, মোবাইল টাওয়ারসহ আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। নদী সংকুচিত হওয়ায় এবং অনেক নদী ভরাট হওয়ার কারণে বৃষ্টি ও বন্যার পানি নামতে সমস্যা হয়। ফলে পানি ঢুকে যায় শহর ও গ্রামে। সৃষ্টি হয় বন্যা ও জনদুর্ভোগ। এবারের কয়েক দিনের একদিকে টানা বৃষ্টি, অন্যদিকে বন্যায় এবার মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। বন্যায় ঘর-বাড়ি, বাজার, ব্যাংক সব চলে গেছে পানির নিচে। সুনামগঞ্জ শহরের প্রায় সব এলাকা আর সিলেটের অনেক এলাকায় বাড়ির নিচতলা ডুবে গিয়ে পানির ট্যাংক, টিউবওয়েল পানিতে তলিয়ে গেছে। হাওরাঞ্চলে প্রবল বাতাস হচ্ছে, হাওরের এই বাতাসের কারণে বাড়িঘর ভেঙে যাচ্ছে। পানিতে ডুবে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্বাভাবিক সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সেখানকার টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। সম্পদহানি হয়েছে। গবাদিপশুর জন্য একটা বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে। আবার সড়কগুলো ডুবে যাওয়ায় সেখানেও বড় ক্ষয়ক্ষতি হবে। তাই হাওরের অবকাঠামো নির্মাণে সেখানকার প্রতিবেশের বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। পানিপ্রবাহে কম বাধাগ্রস্ত হয় সে রকম প্রকল্প নিতে হবে। তবে আশার কথা গত দুদিন ধরে সেখানে পানি কমার কথা শোনা যাচ্ছে। যদিও সামনে আরও তিন মাস আবার বন্যা হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনাও রয়ে যায়। এ বছর সিলেটের সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলেও প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। এবারের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক।

১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যা দেখেছি আমি। তখন সবার এক রকম প্রস্তুতি থাকত। অনেকের নিজেদের নৌকা থাকত। বন্যার প্রকোপ কমে আশায় সেই প্রস্তুতিও কমে গেছে।

এবার বন্যায় বিপদ দেখা গেল আরেক চিত্র। এবারের বন্যায় মানবিক বিপর্যয়ের সময় আমরা কিছু অমানবিক কার্যক্রম দেখতে পেয়েছি। একজন অন্তঃসত্তা নারীকে পারাপারে এক নৌকার মাঝি ৪০-৫০ হাজার টাকা দাবি করেছেন। অবশ্য এই বিপর্যয়ের সময় সেনাবাহিনীসহ প্রশাসনের ভূমিকা প্রশংসার। স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি আটকে পড়া পর্যটকদেরও উদ্ধার করা হয়েছে। আমরা মানুষের বিপদে প্রতিবেশীকে এগিয়ে আসতে দেখেছি। তবে এবার যেন তার বিপরীত কিছু অমানবিক আচরণ দেখা গেল। কিন্তু দেশজুড়ে বন্যার্তদের পাশে থাকার যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে, তা আশা জাগায়।

সাধারণত জুন মাসে এমন বন্যা হওয়ার কথা নয়। এবার বেশ আগে থেকে মে মাসেই নদনদীর পানি বাড়ার খবর আসছিল, সেই সঙ্গে অতিবৃষ্টি। মে মাসের বন্যার ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই আবার জুনেই সিলেট-সুনামগঞ্জসহ দেশের অনেক জায়গাতেই আবারও বন্যা। বিশেষজ্ঞরা সীমান্তের ওপারে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, নি¤œচাপ, নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়াকে বন্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে।

বন্যা বাংলাদেশের এক নিত্যবাৎসরিক ঘটনা। সাধারণত জুলাই থেকে আগস্ট মাস বন্যার ঝুঁকি থাকে। ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালে বাংলাদেশ অন্যতম ভয়াবহ বন্যায় দেশের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। এর ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটে। বন্যার কারণে বাংলাদেশে সাধারণত আমন ধানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর ফলে অনেক সময় দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। বন্যার ঘটনা প্রায় বছরই ঘটার কারণে বিপুল পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী ব্যয় করতে হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনসহ কৃষি পুনর্বাসনেও সরকারকে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। বন্যায় বাংলাদেশের সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ ক্ষয়ক্ষতি দেশের স্বাভাবিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে।

২০০০ সালে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অপ্রত্যাশিত বন্যা হয়। এ বন্যায় সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং প্রাণহাসি ঘটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির দিক বিবেচনায় বন্যা অন্যতম একটি বড় কারণ। বন্যার ক্ষয়ক্ষতিকে সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনতে সরকার নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। বন্যার তীব্রতাকে সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রধান ভূমিকা পালন করে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রধান প্রধান কর্মসূচিগুলো হলোÑফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান, ফ্লাড হাইড্রোলজি স্টাডি, ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট স্টাডি, ন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান, ন্যাশনাল ওয়াটার পলিসি, ফ্লাড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম স্টাডি ইত্যাদি।

বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে প্রতি বছরই বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, নদীভাঙন, খরা, শৈতপ্রবাহ, ভূমিধস, অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদির কোনো না কোনো দুর্যোগ এ দেশে আঘাত হেনে থাকেই। জলবায়ুর পরিবর্তন বাংলাদেশে দুর্যোগের মাত্রা ও তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।

বিশ্বের যে ক’টি দেশ জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকিতে রয়েছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। জনসংখ্যার বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তন ও দারিদ্র্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর প্রথম সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন সপ্তম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম।

‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। জার্মানিভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মানওয়াচ থেকে এটি প্রকাশিত হয়েছে। তাই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তথ্যের আদান-প্রদান বাড়াতে হবে। আঞ্চলিক সমন্বয় বাড়াতে হবে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে যে এসব বিপর্যয় হচ্ছে, তা অস্বীকার করা যাবে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি ও তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ছাড়াও এ দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে আসছে। এ কারণে প্রকৃতিগতভাবে দুর্যোগে করণীয় সম্পর্কে এদেশের মানুষের মধ্যে নিজস্ব একটি কৌশল গড়ে উঠেছে। আগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে ত্রাণ নির্ভরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপটে সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দুর্যোগ প্রস্তুতি কার্যক্রমকে জোরদার করে ঝুঁকি হ্রাসের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণ আগের চেয়ে অধিক শক্তিশালী ও আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে জনগণের সহযোগিতা প্রদানে সদা প্রস্তুত। বাংলাদেশে দুর্যোগকালে নিরাপদ হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকার ভূমিকম্প ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরার লক্ষ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অগ্রাধিকার দিয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করেছে। পাশাপাশি দুর্যোগকালে ও দুর্যোগের পর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যেমন, আহতদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে স্থানান্তর করা ও জরুরি চিকিৎসাসেবা দেয়া, নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং জরুরি খাদ্য-বস্ত্রের ব্যবস্থা করাসহ সফলভাবে দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়েছে। সম্মিলিতভাবে দুর্যোগে মানুষের পাশে থেকে তাকে আরও বেগবান করতে হবে। এ সাফল্যের ধারাকে এগিয়ে নিতে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আসুন, আজ বন্যার কঠিন সময়ে সময়ে, দুর্যোগকালে ও দুর্যোগের পর দুর্যোগ-কবলিত মানুষের স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য জরুরি সেবা প্রদানে আমাদের সমন্বিত প্রচেষ্টাকে আরও জোরদার করি। বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে থেকে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে হাত বাড়িয়ে দিই। তাদের সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করার জন্য আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ হই।

গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com