শাহ মুনতাসির হোসেন : সভ্যতার শুরু করে ক্রমান্বয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি সম্প্রদায় বা সমাজ নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সমাজ গঠনকে সমৃদ্ধ করে তা মানবসভ্যতার বিকাশকে সঠিকভাবে বিকশিত করে। এতে সমাজের পাশাপাশি বিকশিত হয় সমাজে বসবাসরত মানুষের আচার আচরণ, তাদের ইতিবাচক চিন্তা চেতনা ও গঠনমূলক সামগ্রিক উন্নয়ন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে বেশ কিছু বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। প্রতিটি বিপ্লব সভ্যতার ক্রমবর্ধমান উন্নয়নকে সামনের দিকে ধাবিত করে। তš§ধ্যে শিল্প বিপ্লব অন্যতম। এই শিল্প বিপ্লব মানবসভ্যতা ও মানবসমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন করে। আঠারো শতকের শেষাংশ বা উনিশ শতকের শুরুর এই শিল্প বিপ্লব মানুষের জীবনযাত্রার মান, কলাকৌশলে পরিবর্তন নিয়ে আনে। তখন কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার বদলি যান্ত্রিক নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার চালু হয়। ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মানের পাশাপাশি সামাজিক সূচক ও স্তরগুলোর ভিত্তিপ্রস্তর শক্তিশালী করে। আর এই সূচিত শিল্প বিপ্লবের ফলে আধুনিক সমাজকর্মের উদ্ভব হয়। অর্থাৎ শিল্প বিপ্লবের ফলে সংঘটিত আধুনিক ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের প্রকৃত ফলাফল হচ্ছে আজকের আধুনিক সমাজকর্ম।
একটি সামাজিক সুশৃঙ্খল কাঠামো ব্যবস্থাপনায় যে কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে সমাজের গুণগত মান বৃদ্ধি ও ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত করা হয় তা-ই হচ্ছে সমাজকর্ম, যা সমাজের ব্যক্তি, দল, সম্প্র্রদায় ও সমাজ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মৌলিক চাহিদা মেটানোর মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত কল্যাণ নিশ্চিত করে। অপরদিকে সমাজবিজ্ঞান হলো মানব বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন যা সমাজ, মানুষের সামাজিক আচরণ, সামাজিক সম্পর্কের ধরন, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত সংস্কৃতির দিকগুলোর ওপর দৃষ্টিপাত নিবদ্ধ করে।
সমাজকর্ম ও সমাজবিজ্ঞান সামাজিক বিজ্ঞান ও মানবিক অনুষদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। প্রেক্ষাপট, অবস্থান, লক্ষ্য, উদ্দশ্যে ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী দুটো এক নয়।
সমাজকর্ম এবং সমাজবিজ্ঞান দুটো বিষয় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিষয় হওয়া সত্ত্বেও বেশ তারতম্য রয়েছে বিষয় দুটোর মধ্যে। সমাজকর্ম হচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যবহারিক বিজ্ঞান। বিষয় হিসেবে সমাজকর্ম যথেষ্ট বিজ্ঞান সম্মত এবং কারিকুলাম আন্তর্জাতিক ইস্যু ও প্রেক্ষাপটকে প্রাধান্য দিয়ে ডেকোরেটেড করা হয়। সমাজকর্ম সমাজের নানা অনাকাক্সিক্ষত বিষয়, সমাজে কি কি সমস্যা হচ্ছে, সেসব সমস্যা চিহ্নিত করে তা দূরীকরণে কাজ করে। সমাজকর্ম হচ্ছে পেশাভিত্তিক একটি বিষয়, যা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ডাক্তার, নার্স প্রকৌশলী, শিক্ষকের মতো সমাজকর্ম একটি সম্মানজনক পেশা হিসেবে স্বীকৃত ও ব্যাপকভাবে সমাদৃত। সমাজকর্ম পেশার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিকে সমাজকর্মী হিসেবে অভিহিত করা হয়। আর সমাজবিজ্ঞান একটি তাত্ত্বিক বিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞান হলো সমাজের প্রায়োগিক ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞান, যা সমাজের উৎপত্তি, বিকাশ ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়াসহ সমাজের পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে। তাছাড়া সমাজবিজ্ঞান সমাজের মানুষের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক অবস্থানকে যোগসূত্র করে।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিষয়গুলোর মধ্যে সমাজকর্ম বৈচিত্র্যময় একটি বিষয়। কারণ সমাজকর্ম বিষয়ের সঙ্গে অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, জনস্বাস্থ্য, মনোবিজ্ঞান, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, সামাজিক গবেষণা ও পরিসংখ্যান, অপরাধবিজ্ঞান, কাউন্সেলিং, কমিউনিটি মেডিসিন ইত্যাদি বিষয়াবলি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। সমাজকর্ম ও সমাজবিজ্ঞানের থিংক ট্যাংক সম্পূর্ণ ভিন্ন। সমাজকর্ম একটি সমাজের বা সম্প্রদায়ের মধ্যে কি কি সমস্যার উদ্ভব হয় বা কি কি কারণে সমাজের চরিত্রের নেতিবাচক পরিবর্তন হয়। সেসব কারণগুলো চিহ্নিত করে তা নিমূর্ল করা সমাজকর্মের প্রধানতম উদ্দেশ্য। আর সমাজবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজ ও বিজ্ঞানের সংযোগের দ্বারা সমাজের বা সম্প্রদায়ের মধ্যে যেসব সমস্যার উদ্ভব হয় সেসব সমস্যা সম্পর্কে সম্মুখ সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে ব্যাখা প্রদান করা।
সমাজকর্মের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। এই পেশাটির জন্ম ইংল্যান্ডে এবং আমেরিকায় প্রায় ২০০ বছর আগে এই পেশার প্রচলন শুরু হয়। শুরুর দিকে এটি স্বেচ্ছাসেবী কাজ হিসেবে ধরা হলেও পরে এটি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এটি পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বৈশ্বিকভাবে ১৮৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ শতকের দিকে ইউরোপসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আধুনিক সমাজকলাণ বা সমাজকর্ম একটি ব্যবহারিক সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে পঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ পরবর্তীকালে সৃষ্ট পাকিস্তানে ভারত থেকে আসা অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন আর্থসামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। সৃষ্ট সমস্যার সমাধানের জন্য তৎকালীন সরকার জাতিসংঘের কাছে আবেদন করেন। সে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের কারিগরি সাহায্য কর্মসূচির আওতায় ১৯৫২ সালে ড. জেমস্ আর ডুম্পসনের নেতৃত্বে জাতিসংঘের ছয় সদস্যবিশিষ্ট সমাজকর্ম বিশেষজ্ঞ দল এ দেশে আগমন করেন। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দল এ দেশের সার্বিক আর্থসামাজিক অবস্থার জরিপ ও পর্যালোচনা করে পেশাদার সমাজকর্মের প্রবর্তন এবং স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থার বিকাশের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালে জাতিসংঘের সহায়তায় তৎকালীন সরকারের উদ্যোগে ৯ মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু হয় এবং সেসময়েই ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স কোর্স চালু করার প্রস্তাব রাখা হয়। তারও পরে ঢাকায় দেশের প্রথম সমাজকর্মের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ‘কলেজ অব সোশাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয় যা ১৯৭৩ সালে রূপান্তরিত করা হয় ‘সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ’ নামে। তখন থেকেই সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউট সমাজকর্মের ওপর স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি দিয়ে আসছে।
বিপরীতে সমাজবিজ্ঞান রাষ্ট্রীয় দর্শন, ইতিহাসের দর্শন, জীববিজ্ঞানের বিবর্তনবাদ এবং সামাজিক জরিপ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। তবে সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভবের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। কিন্তু সমাজব্যবস্থা ও সমাজজীবনকে জানার এবং বুঝার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে চিন্তার আদি উন্মেষ থেকে। সমাজ সম্পর্কে চিন্তা ভাবনার ইতিহাস সমাজের মতোই প্রাচীন। মূলত সমাজ জীবনের সমস্যা সম্পর্কিত চিন্তা ভাবনার সূত্রেই আবির্ভাব ঘটেছে সমাজবিজ্ঞানের। তবে শুরুর দিকে মুখ্য বিষয় হিসেবে নয় বরং আনুষঙ্গিক বিষয় হিসেবেই সমাজ সম্পর্কিত চিন্তা ভাবনা শুরু হয়েছিল। আর একটি আলাদা বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের জন্ম মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পাশ্চাত্য শিল্প বিপ্লব ও রাজনৈতিক সামাজিক বিপ্লবের যুগে।
আধুনিক ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিনির্ভর এই যুগে সময় প্রতিনিয়ত আধুনিকায়ন হচ্ছে। সময় যখন একদিকে আধুনিকায়ন হচ্ছে তেমনি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একটি সমাজে নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন- তৃতীয় বিশ্বের এই সময়ে বাল্যবিবাহ, মানব পাচার, যৌতুক, আত্মহত্যা, নারী সমস্যা ইত্যাদি সামাজিক সমস্যা এখনও সমাজে চিহ্নিত সমস্যা হিসেবে স্বীকৃত। সমাজে এসব সমাধানের জন্য সমস্যাগুলোর বিশ্লেষণ যেমন জরুরি তেমনি সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে দক্ষ সমাজকর্মীর বিকল্প নেই। একজন দক্ষ সমাজকর্মী সমাজকর্ম বিষয়ে তার অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা, কলাকৌশল, চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে যতটা সহজে প্রশিক্ষিত জ্ঞানের প্রয়োগ করতে পারে একজন সমাজব্যবস্থায় ততটা সহজে তা পারে না। কারণ দুটো বিষয়ের পড়ানোর ধরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। সমাজকর্মে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীকে দুই মাসের ফিল্ড ওয়ার্ক বা মাঠকর্মে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ করতে হয়। এই ফিল্ড ওয়ার্ক এনজিও, হাসপাতাল, গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত হয়Ñ যা সমাজবিজ্ঞানে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের করা হয় না।
কিন্তু সমাজকর্ম ও সমাজবিজ্ঞান উভয় বিষয়ের মাঝে বিষয়ভিত্তিকভাবে অনেক প্রার্থক্য থাকার ফলেও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সমাজকর্ম ও সমাজবিজ্ঞান দুটো বিভাগকে মিলে একটি বিভাগে একীভূত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বাংলাদেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও বেশকিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু যতই সীমাবদ্ধতা, সমস্যা থাকুক। তাই বলে সমাজকর্মের মতো আন্তর্জাতিকভাবে একটি পেশাদার বিষয়কে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের সঙ্গে পুরোপুরি মিলিয়ে ফেলা আত্মঘাতী একটি সিদ্ধান্ত। যেখানে বিভাগ থেকে ইতোমধ্যে দুটো ব্যাচ স্নাতক সম্পন্ন করেছে এবং একটি ব্যাচের স্নাতকোত্তর চলমান রয়েছে। এরুপ একটি সিদ্ধান্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও হতাশার সৃষ্টি করে। কারণ শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে। এই সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষার্থীরা সরকারি, বেসরকারিসহ চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হবে। যা তাদের ক্যারিয়ারের জন্য অশনি সংকেত।
অচিরেই বাংলাদেশে সমাজকর্ম একটি পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। সে পর্যায়ে রয়েছে সমাজকর্ম। সেজন্য সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের বিভাগের স্বতন্ত্রতা অক্ষুণ্ন রাখতে বদ্ধপরিকর।
তাই নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হোক। এতে সমাজকর্ম বিভাগের স্বতন্ত্রতা নিশ্চায়নের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীরা দেশ ও জাতির কল্যাণে শতভাগ অবদান রাখতে পারবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়