মো. রায়হান আলী: সদ্য সমাপ্ত হওয়া ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনকে নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক আলোচনা-সমালোচনার কমতি নেই। এ নির্বাচন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যমগুলো বেশ তৎপর ছিল। নির্বাচনে অনেক প্রার্থী থাকলেও বিজয়ী হয়েছেন নৌকা প্রতিকের প্রার্থী। বিজয়ী প্রার্থীকে নিয়ে তো তেমন আলোচনা বা সমালোচনার কিছু নেই গণমাধ্যমে। কিন্তু পুরো নির্বাচন ঘিরে কিংবা নির্বাচন-পরবর্তী ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সতন্ত্র প্রার্থী মো. আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমকে নিয়ে এখনও সারাদেশ বা বিদেশেও আলোচনা চলছে। নির্বাচন প্রচার-প্রচারণাকালীন অনেক বাধা-বিপত্তির শিকার হয়েছেন মি. হিরো আলমের ভাষ্য মতে। এছাড়া নির্বাচনের ভোট গ্রহণের দিন একেবারেই হয়তবা ভোট শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে এ মি. হিরো আলমকে প্রকাশ্যে রাস্তায় পিটিয়েছে একদল দুষ্কৃতকারী। আহত হয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছিলেন মি. হিরো আলম। এ দুষ্কৃতকারীদের হামলায় আহত মি. হিরো আলম গণমাধ্যমে তার আহত হওয়ার ঘটনায় বলেছিলেন, ‘দুষ্কৃতকারীরা যখন তাকে আক্রমণ করে তখন তিনি অনেক ডাকাডাকি চিল্লালেও কোনো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা এ ঘটনার কাছাকাছিই ছিল’।
এ ঘটনাটির ভিডিও ধারণ করেছে মিডিয়াকর্মীরা। তাই সারা নেটজুড়ে হিরো আলমকে পেটানোর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এ ঘটনায় মি. হিরো আলমকে নিয়ে অনেক দায়িত্বশীল ইতিবাচক মন্তব্য (পজিটিভ কমেন্ট) করেছেন।
এ হামলার ঘটনায় ইতোমধ্যে নিন্দা জানিয়েছে ১২টি দেশের দূতাবাস ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এক যৌথ বিববৃতিতে তারা বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সহিংসতার কোনো স্থান নেই। ‘আমরা পূর্ণ তদন্ত এবং জবাবদিহিতার আহ্বান জানাই।’ তারা বলেন, আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী দূতাবাস এবং হাইকমিশনের মধ্যে রয়েছে কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
অনেকে বলেছেন, মি. হিরো আলম এ নির্বাচনে অপর কোনো প্রার্থীর নামে বিষোদগার করেনি, কারও নামে কটূক্তি করেনি। অনেক সনদধারী প্রার্থীর চেয়েও সুন্দর সাজানো-গোছানো রুচিশীল বক্তব্য দিয়েছেন।
এবার আসি মূল আলোচনার বিষয়, কারা এই মি. হিরো আলমকে হিরো বানিয়েছে। সব প্রকার হিরোরেই হিরো হতে ব্যক্তিগত জীবনে অর্জন লাগে। ঠিক এই মি. হিরো আলমেরও আজ হিরো হতে অনেক অর্জন করতে হয়েছে। আলোচিত মি. হিরো আলম একাধারে বিভিন্ন প্রতিভার অধিকারী (অনন্য না হোক ব্যতিক্রমী তো বটেই) হিসেবে অনেকের কাছে পরিচিত। যেমন- বাংলাদেশী সংগীত ভিডিও মডেল, অভিনেতা, গায়ক এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত ব্যক্তি। তিনি একজন স্বাধীন শিল্পী হিসেবে কাজ করেন ও সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলিতে ভিডিও প্রকাশ করে থাকেন। তিনি মূলত তার বেসুরো গলায় গানের জন্য সর্বাধিক আলোচিত, সমালোচিত। এই কারণে তিনি বিভিন্ন ইন্টারনেট মিমের উপাদানে পরিণত হয়েছেন।
২০১৮ সালে হিরো আলম একাদশ সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৪ আসনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে পুনরায় আলোচনায় আসেন। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করলে বগুড়া-৬ (সদর) এবং বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। হিরো আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দুটো আসনেরই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। ২০২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে তিনি অল্প ভোটের ব্যবধানে উভয় আসনে পরাজিত হন। পরাজিত হয়েও জয়ী প্রার্থীর চেয়ে আলোচনায় সর্বত্রই। মি. হিরো আলমের প্রার্থিতা নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু বলেছিল। তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, নায়িকা মাহিয়া মাহি, ক্রিকেটার মাশরাফি এবং গায়িকা মমতাজ যদি প্রার্থী হতে পারেন, তাহলে আমি হতে পারব না কেন? নির্বাচনে হিরো আলম হেরে যাওয়ার পর গণমাধ্যমকে এও বলেছেন, ‘শিক্ষিত সমাজের কিছু লোক আছেন, যারা আমাকে মেনে নিতে চান না। তারা মনে করেন, আমি পাস করলে বাংলাদেশের সম্মান যাবে, তাদের সম্মান যাবে। আমরা এত শিক্ষিত, হিরো আলমের মতো মূর্খকে ‘স্যার’ বলে ডাকতে হবে। এ জন্য তারা আমাকে মানতে চান না।’
এই হিরো আলমের ছোট বেলা থেকে বেড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে কাব্যিক কাহিনী। সিডি বিক্রি করতেন আশরাফুল আলম। সেটা বেশ আগের ঘটনা। সিডি যখন চলছিল না তখনই মাথায় আসে ক্যাবল নেটওয়ার্ক ব্যবসার। ভাবলেন নিজ গ্রামেই সেটা করবেন এবং করে ফেললেন। বগুড়ার এরুলিয়া ইউনিয়নের এরুলিয়া গ্রামেই শুরু হয় আলমের ডিশ ব্যবসা। ছোটবেলা থেকেই অভাব-অনটনের সঙ্গে চলা আলমের পরিবার তাকে আরেক পরিবারের হাতে তুলে দেয়। আলম চলে আসেন একই গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের বাসায়। আব্দুর রাজ্জাক তাকে ছেলের মতো করেই বড় করে তোলেন। স্নেহ করতেন। কিন্তু গ্রামে অভাব তো প্রায় মানুষের আছে। আলমের পালক পিতা আব্দুর রাজ্জাকের সংসারেও অভাবের ছোঁয়া পায়। স্থানীয় স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে আলমকে নেমে পড়তে হলো জীবিকা নির্বাহের তাগিদে। সিডি বিক্রি থেকে আলম ডিশ ব্যবসায় হাত দিয়ে সফলতা অর্জন করেন। তার মাসে আয় ৭০-৮০ হাজার টাকা। সব মিলে জীবন সংগ্রামী এক ব্যক্তি তিনি। জীবন সংগ্রামী, ব্যবসায়ী, নাট্যকারসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা মহান জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
তথ্য বলছে, বর্তমান দশম সংসদের মূল ৩০০ এমপির মধ্যে ২০৬ জনেরই পেশা ব্যবসা। অর্থাৎ ব্যবসায়ী এমপির হার ৬৯ শতাংশ। সংরক্ষিত নারী আসনসহ ব্যবসায়ী এমপির মোট সংখ্যা হিসাব করলে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ২১৪ জনে। সংসদ সচিবালয়কে এমপিদের দেয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দশম সংসদে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেশি। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন আইনজীবী, তৃতীয়তে আছেন রাজনীতি পেশার সদস্যরা। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ব্যবসায়ী এমপি রয়েছেন ২১৪ জন, আইনজীবী ৪৮ জন, রাজনীতিকে পেশা বলেছেন মাত্র ২২ জন। ব্যবসায়ী এমপির মধ্যে আ’লীগের ১৭০ জন, জাতীয় পার্টির ২৪ জন, স্বতন্ত্র ১৪ জন, জাসদ, তরিকত ফেডারেশন, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জেপি মিলিয়ে ৬ জন। বর্তমানে জাতীয় সংসদে ৬৯ শতাংশ ব্যবসায়ী সংসদ সদস্য।
আলোচিত হিরো আলম এদেশের একজন নাগরিক। তিনি বর্তমানে একজন পেশাদার অভিনেতা ও সফল উদ্যোক্তাও বটে।
যেটুকু জেনেছি এখন পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার বাধ্যবাধকতা বা কোনো সীমাবদ্ধতা রাখা নেই বর্তমানে। যদি এমনটাই হয় তাহলে মি. হিরো আলম নির্বাচনে প্রার্থী হওয়াতে আইনগত কোনো বাধা না থাকা সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে তাকে নিয়ে এত কৌতূহল কেন? যারা উচ্চ শিক্ষিত হয়ে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পাস করে তারা কি শতভাগ নির্বাচনী ইশতেহার পূরণ করে? নিশ্চয়ই সবাই করে না, তাহলে তাদের নিয়ে তো আমাদের আলোচনা-সমালোচনার ঝড় দেখি না। তাহলে যত দোষ, এই মি. হিরো আলমদের ঘাড়ে! বিশ্বের অনেক বড় বড় নেতা হয়েছে তৃণমূল ও অনেক খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে। মি. হিরো আলম নেতা বা জনপ্রতিনিধি হলেই যত দোষ! আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের ও আমাদের সমাজের আমূল পরিবর্তন আনতে হলে আগে আমাদের মানসিক উন্নতির উšে§ষ ঘটাতে হবে। এ মি. হিরো আলমকে জনগণ তথা তার ভক্তরাই হিরো বানিয়েছে সবার মাঝে। মিডিয়াজুড়ে এ হিরোর আলোচনা-সমালোচনা। রুচির দুর্ভিক্ষ আসলে সমাজে না, মনেই ধরেছে! সাধারণ মানুষের অনেকেই মনে করছেন হিরো আলমের উত্থান যদি রুচির দুর্ভিক্ষ হয়, ঢাকা-১৭ আসনে তার সঙ্গে রুচিবানদের আচরণ নিশ্চয়ই নৈতিকতার দুর্ভিক্ষ। সেখানে নির্বাচনে হয়তো তিনি জিততে পারেনি কিন্তু অনুসারী-ভক্তদের কাছে তিনি হিরো হয়েই বেঁচে আছেন।
আইনজীবী ও মুক্ত লেখক
খুলনা