Print Date & Time : 19 August 2025 Tuesday 12:42 am

সরকারি উদ্যোগে নগরীয় কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে

নিতাই চন্দ্র রায়: জলবায়ু পরিবর্তন, ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছাস ও নদী ভাঙনের ফলে প্রতিদিনই নগরগুলোয় জড়ো হচ্ছে বাস্তুচ্যুত অসংখ্য মানুষ। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এক দশমিক ৩৭ শতাংশ হলেও নগরগুলোতে জনসংখ্যা বাড়ছে পাঁচ শতাংশ হারে। ১৯৭১ সালের শুরুতে বাংলাদেশে মোট নগরবাসীর সংখ্যা ছিল ৫০ লাখ। বর্তমানে তা বেড়ে পাঁচ কোটি ৪০ লাখে দাঁড়িয়েছে। আগামী ৩৫ বছরে এই সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। নগরে বসবাসকারী এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে কৃষি কর্মকাণ্ডের বাইরে রেখে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা কোনো অবস্থায়ই সম্ভব হবে না। এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম ‘উন্নয়নে নগরায়ণ’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘শহরের অর্থনীতি মানেই অকৃষিভিত্তিক কর্মকাণ্ডের ওপর গড়ে ওঠা অর্থনীতি। শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, সেবা, বিনোদন এসবের ওপর নির্ভর করা নগর অর্থনীতিতেও কৃষির অবদান একেবারে নগণ্য নয়। আফ্রিকার কোনো কোনো শহরে এই আয়ের পরিমাণ শহরের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রায় ২০ শতাংশ। ঢাকাসহ আমাদের বিভিন্ন শহরের সীমার মধ্যেও নানা রকম কৃষিকাজ, শাকসবজি, ফল, ফুল চাষ, মৎস্য চাষ, মুরগির খামার, গাভী পালন এবং দুগ্ধ উৎপাদন যথেষ্ট অবদান রাখছে। আজকাল অনেক নগরবিদ ও পরিবেশবিজ্ঞানী শহরাঞ্চলে কৃষিকাজের পক্ষে জোরালো যুক্তি রাখছেন। আমরাও মনে করি, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নগরীতে পরিকল্পিতভাবে কৃষিকাজের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।’

যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, কেনিয়া, সুইডেন প্রভৃতি দেশে নগরীয় কৃষির মাধ্যমে নগরবাসীর অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের উৎপাদিত খাদ্যের ১৫ শতাংশ উৎপাদিত হচ্ছে নগরে। যত দিন যাচ্ছে নগরবাসীর সংখ্যা ও নগরীয় খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ততই বাড়ছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও নগরীয় এলাকার মানুষের খাদ্য-পুষ্টি নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়ন ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য নগরীয় কৃষির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করছে। বিভিন্ন দেশে ১২টি প্রতিষ্ঠান নগরীয় কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে বাসিন্দাদের কারিগরি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে উগান্ডার ক্যাম্পালায় গ্রিন ক্যাম্প, থাইল্যান্ডের ব্যাংককের সিটি ফার্ম প্রজেক্ট, ইতালির মিলানে ইকোনমিকস অ্যান্ড সাসটেইন্যাবিলিটি, গাজায় আরবান অ্যান্ড প্যারি আরবান অ্যাগ্রিকালচার, হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে গ্রান্ড গার্ডেন, কেনিয়ার নাইরোবিতে মেজিনজিরা ইনস্টিটিউট, যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে আরবান ফার্মিং ইনেশিয়েটিভ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

আমাদের দেশে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন নগরে ব্যক্তিগত ও অপরিকল্পিতভাবে নগরীয় কৃষির কিছু কর্মকাণ্ড চললেও এখন পর্যন্ত তা প্রাতিষ্ঠানিকতা পায়নি। সাভারের ব্যাংক কলোনি, উত্তরা, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি ও গুলশানের বিভিন্ন বাড়ির ছাদে ব্যক্তি-উদ্যোগে শাকসবজি, ফলফুল ও ভেষজ উদ্ভিদের বাগান গড়ে তোলা হচ্ছে। এ কাজে মহানগর কৃষি কর্মকর্তারা কারিগরি সহায়তা দিচ্ছেন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বাড়ির ছাদে বাগান করতে রাজধানীবাসীকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন ঘোষণা দিয়েছেন বাড়ির ছাদে, বারান্দায় কিংবা আঙিনায় বাগান গড়ে তোলা হলে বাড়িমালিকদের গৃহকর ১০ শতাংশ মওকুফ করা হবে। তার এই ঘোষণা অভিনন্দনযোগ্য এবং দেশের সব নগরে অনুরূপ কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত। উত্তরের মেয়র আনিসুল হক আগামী তিন বছরের মধ্যে সবুজ ঢাকা গড়তে পাঁচ লাখ গাছ লাগানোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকা কম খরচে ছাদে অরগানিক ফসল চাষের জন্য প্যাকেজ সেবা চালু করেছে। ঢাকা নগরীতে বহুদিন ধরে ছাদে বাগান সৃজন কাজে বেসরকারি সংগঠন ‘বাংলাদেশ গ্রিন রুফ মুভমেন্ট’ অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগী ভূমিকা পালন করে আসছে।

গ্রামীণ কৃষির সঙ্গে নগরীয় কৃষির অনেক পার্থক্য রয়েছে এ কথাটি দেশের পরিকল্পনাবিদ, রাজনীতিবিদ, কৃষিবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বুঝতে হবে। নগরীয় কৃষির জন্য গ্রামীণ কৃষির মতো দিগন্তবিস্তৃত মাঠ ও উর্বর জমি পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে না হাওর অঞ্চলের মতো জলাশয়। এখানে বাড়ির ছাদ, বেলকোনি, বারান্দা, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ ও কলকারখানার খালি জায়গা, রাস্তার সড়কদ্বীপ, লেকের পাড়, মন্দির-মসজিদের অব্যবহৃত জমিকে কৃষিকাজে ব্যবহার করতে হবে। এজন্য নগরীয় কৃষিতে ছাদে-বারান্দায় বাগান ছাড়াও হাইড্রোপনিকস পদ্ধতিতে ভবনের প্রতিটি তলায় মাটিবিহীন সবজি উৎপাদন, ছাদে অ্যাকোয়াপনিকস পদ্ধতিতে মাছ ও সবজি উৎপাদন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাশরুমের চাষ, বস্তায় সবজি চাষ, চৌবাচ্চায় মাছের চাষ, খাঁচায় মুরগি ও খরগোশ পালনের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নগরের পরিত্যক্ত পুকুর, ভরাট লেক, খালবিল ও নদীনালা দখলমুক্ত ও পুনঃখনন করে মাছ, ঝিনুক, কাঁকড়া ও উপকারী জলজ উদ্ভিদের চাষ করতে হবে এবং নগরের প্রধান প্রধান নালাকে এসব খাল এবং খালবিলকে নগর-পার্শ্ববর্তী নদীর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এতে নগরবাসী জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পাবেন এবং ফরমালিনমুক্ত তাজা মাছ পাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে।

ব্যাংকক, বেইজিং, সিউল প্রভৃতি নগরের বড় হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোয় মিনি পুকুরে ভোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় মাছ উৎপাদন করা হয় নগরীয় কৃষির মাধ্যমে। অনেক দেশে বসতবাড়িতে ছোট ছোট চৌবাচ্চায় তেলাপিয়া মাছ চাষ করা হয়। আমাদের দেশেও এসবের প্রচলন করতে হবে। ব্র্যাক ও মিল্ক ভিটা আর কত দিন উত্তরাঞ্চল থেকে দুধ সংগ্রহ করে নগরবাসীকে প্যাকেটজাত দুধ, মাখন ও ঘি সরবরাহ করবে? আমার জানামতে, পাবনা শহরের অনেক মিষ্টির দোকানের মালিক মিষ্টি, দুধ ও ঘি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় দুধ নিজেদের গোখামারেই উৎপাদন করছেন। এ দৃষ্টান্ত অন্য শহরে ছড়িয়ে দিতে হবে। গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলা শহরের শিল্পী হোটেলও নিজস্ব গোখামারের দুধ থেকেই দই উৎপাদন করে ভোক্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।

রাজধানীর উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের বাড়ির ছাদে বাগান করেছেন শাহজাদা সেলিম। ছাদটি তৈরি করা হয়েছে গাছ লাগানোর উপযোগী করে। পানি নিষ্কাশন ও চারাগাছ লাগানোর জন্য আছে বিশেষ ব্যবস্থা। সেই ছাদে লাগানো হয়েছে গাজর, মরিচ, টমেটো ও নানারকম মৌসুমি শাকসবজি। ফলের মধ্যে লাগানো হয়েছে ডালিম, মাল্টা, লেবু, করমচা, আম ও স্ট্রবেরি। নানা রকমের ফুলের গাছও আছে ওই বাগানে। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক। উৎপাদিত ফলমূল, শাকসবজি নিজেরা খান এবং আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের বাড়িতে পাঠান। যারা ভাড়া বাসায় থাকেন, ছাদে বাগান করার সুযোগ নেই, তারাও বারান্দা, চিলেকোঠা, সিঁড়ির কিনারা ও জানালার পাশের টবে গাছগাছালি রোপণ করছেন। এতে একচিলতে জায়গায়ও সবুজের সমারোহ ঘটানো সম্ভব। শাহাজাদা সেলিমের মতো উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরের ছাদে বাগান গড়ে তুলেছেন দেলোয়ার হোসেন। তিনিও একজন চিকিৎসক।

ছাদে বাগান শুধু রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ নেই, তা রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর, পিরোজপুর ও সিরাজগঞ্জের মতো জেলাশহরেও সম্প্রসারিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রোস্তম আলী অফিসের ছাদে নিজস্ব পরিকল্পনায় ও অর্থায়নে বাগান তৈরি করে নগরীয় কৃষির এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বর্তমানে তার ছাদবাগানে দেড় শতাধিক সবজি, ফলদ, ওষধি, বাহারি ও মসলাজাতীয় ফসলের গাছ রয়েছে। ফলদ গাছের মধ্যে আম, লিচু, জামরুল, পেয়ারা, পেঁপে, আমড়া, লেবু, কমলা, মাল্টা, কামরাঙ্গা, ড্রাগন, ডালিম ও সফেদা উল্লেখযোগ্য। সবজির মধ্যে রয়েছে বেগুন, শিম, লাউ, শসা, লালশাক, পুঁইশাক ও বিলাতি ধনে। মসলার মধ্যে আছে মরিচ ও তেজপাতা। ফুল ও বাহারি গাছের মধ্যে রয়েছে কলাবতী, বেলী, গন্ধরাজ, রঙ্গন, পামট্রি, ক্রিসমাস এবং ঔষধি গাছের মধ্যে আছে তুলসী, ঘৃতকুমারী ও বাসক। ওই ছাদে তিনটি কেঁচো কমপোস্টের চেম্বার রয়েছে। সেখান থেকে উৎপাদিত সার ছাদবাগানে ব্যবহার করা হয় এবং অতিরিক্ত ভার্মি কমপোস্ট কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। তিনি ওই একই ছাদে পলিব্যাগে লাউ, শিম ও করলার চারা উৎপাদন করে গরিব চাষিদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করছেন। প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তা, কৃষক ও শৌখিন বাগানিরা তার ছাদে বাগান দেখতে ভিড় করেন উপজেলা কৃষি অফিসে।

বর্তমানে রাজধানীতে ৬০ টাকা কেজির নিচে কোনো সবজি পাওয়া যায় না। প্রতি কেজি শিম বিক্রি হচ্ছে ১২০ ও টমেটো বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে। কাঁচামরিচ ১২০ টাকা ও পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০ টাকায়। ঢাকা থেকে দু-তিনশ কিলোমিটার দূরে বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, নাটোর, যশোর ও জয়পুরহাট থেকে পরিবহন করে নিয়ে আসতে সবজির দাম অনেক বেড়ে যায় এবং পুষ্টিমানও কমে যায়। প্রতি ট্রাক সবজিতে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হয়। তারপর রয়েছে রাস্তায় রাস্তায় চাঁদাবাজি ও তিন-চারবার হাতবদল। এসব কারণে মোকামের ক্রয়মূল্যের দ্বিগুণ দামে ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসীকে কিনতে হয় শাকসবজি ও ফলমূলসহ সব ধরনের কৃষিপণ্য। অনেক সময় এসব কৃষিপণ্যকে পচন থেকে রক্ষা করার জন্য স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর নানা রকম রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়। ফল পাকানো হয় কার্বাইড দিয়ে। টমেটোর রং আকর্ষণীয় করার জন্য প্রয়োগ করা হয় মাত্রাতিরিক্ত ইথোফেন নামক হরমোন। অদূর ভবিষ্যতে দূরবর্তী স্থান থেকে আনা এসব ভেজালমিশ্রিত শাকসবজি ও ফলমূল দিয়ে নগরবাসীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। তাই নগরবাসীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে দেশের প্রতিটি নগর ও সেগুলোর আশপাশে সরকারি উদ্যোগে নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে বিলম্ব করার কোনো অবকাশ নেই।

 

সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড

netairoy18Ñyahoo.com