শাকির আহমেদ: দেশে গত কয়েক বছর ধরেই চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবিতে চাকরিপ্রত্যাশীরা বারবার আন্দোলন করে আসছেন। শুধু চাকরি প্রত্যাশীরাই নন, সুশীল সমাজের অনেক প্রতিনিধি এমনকি অনেক সংসদ সদস্যও জাতীয় সংসদে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর যৌক্তিকতা বারবার তুলে ধরেছেন। বর্ধিত আয়ুষ্কাল বিবেচনায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বছর করার সুপারিশ করে। অথচ এ সুপারিশ ফাইলে আটকে আছে। নবম জাতীয় সংসদের ১৪তম অধিবেশনে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার প্রস্তাব গৃহীত হলেও তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালনকালে চাকরিপ্রত্যাশীদের বয়স বিড়ম্বনার বিষয়টি উপলব্ধি করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের কাছে রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত অনেক দেশ যেমনÑযুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডাসহ অনেক দেশেই চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সের বাধ্যবাধকতা আর না করে যোগ্যতাকেই প্রধান মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করা হয়। রাশিয়া, সুইডেন, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং ও ফিলিপাইনে অবসরের আগের দিনও সরকারি চাকরিতে ঢুকতে পারে আর দক্ষিণ আফ্রিকায় চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমাবদ্ধ নয়। ভারতে রাজ্যভেদে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৮ থেকে ৪০ বছর, শ্রীলঙ্কায় ৪৫, ইন্দোনেশিয়ায় ৩৫, ইতালিতে ৩৫ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩৮, ফ্রান্সে ৪০ ও যুক্তরাষ্ট্রে ৫৯ বছর। গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর উদাহরণ থাকলেও বর্তমানে অজানা কারণে বাংলাদেশে তা ত্রিশেই থমকে আছে। এ দেশের মানুষের গড় আয়ু যখন ৪৫ বছর ছিল, তখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ছিল ২৭ বছর। আর গড় আয়ু ৫০ বছর হওয়ার সময় তা বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৫০ বছর থেকে বেড়ে ৭০ বছর বা ততোধিক হয়েছে। কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছরের গণ্ডি থেকে নড়ছে না।
শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন পর্যায় বিশেষ করে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যে পাঠ্যক্রম বিদ্যমান, তা চাকরির বাজারে খুব একটা কাজে আসে না। কেননা বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষা সিলেবাস এবং প্রশ্ন প্রণয়নের ক্ষেত্রে একাডেমিক শিক্ষার অনুসরণ, প্রতিফলন বা প্রয়োগ দেখা যায় না। উদাহরণ দিতে গেলে বলা যায়, স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভালো ফল পেতে একজন শিক্ষার্থী সিলেবাসের আঙ্গিকে পড়ালেখা করেন; বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক না হতে পারলে বিসিএস বা অন্য চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে সে পড়ালেখা খুব একটা কাজে আসে না। সবচেয়ে বড় কথা, চাকরির বাজারে সব নিয়োগ পরীক্ষা একই সিলেবাস অনুযায়ী হয় না। উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে, বিসিএস নিয়োগ পরীক্ষা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা একই পদ্ধতির প্রশ্নে হয় না। ফলে প্রত্যেক পরীক্ষার জন্য ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে প্রস্তুতি নিতে গেলে অনেক সময় ব্যয় হবেÑএটাই স্বাভাবিক।
আর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে কোটা সমস্যা। বাংলাদেশের সব সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা চালু রয়েছে। আর কোটাধারীদেরে ক্ষেত্রে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা শিথিলের জন্য সুবিধা প্রদান করা হয়। ফলে কোটাহীন শিক্ষার্থীরা মেধায় যোগ্য হয়ে চাকরি থেকে ছিটকে পড়ে। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় বিভাগীয় প্রার্থীদের বয়সসীমা শিথিল করে দেওয়া হলেও সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশীদের বেলায় কোনো প্রকার শৈথিল্য প্রদর্শনের কোনো নজির নেই। ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জš§স্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না’Ñসংবিধানের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে এমন উল্লেখ থাকলেও চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হচ্ছে।
বয়সের সীমাবদ্ধতার জন্য অনেক তরুণকেই তড়িগড়ি করে চাকরিতে প্রবেশ করতে হচ্ছে। যার কারণে তরুণরা নিজের দক্ষতা এবং পারদর্শিতা অনুযায়ী আগ্রহের পেশায় নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ হারাচ্ছে। ফলে কেবল রুটিন ওয়ার্ক (দৈনন্দিন কাজ) সম্পাদনকারী দাফতরিক কর্মকর্তা তৈরি হলেও বিভিন্ন সেক্টরে নেতৃত্বদানের যোগ্য দক্ষ জনশক্তি বা জনবল তৈরি হচ্ছে না। অনেকেই আবার যুক্তি দেখান, ত্রিশোর্ধ্বদের জন্য বেসরকারি চাকরির দুয়ার খোলা। কিন্তু এ কথা অবশ্যই মানতে হবে, যে তরুণ প্রজাতন্ত্রের সেবা করার স্বপ্ন নিয়ে নিজেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যোগ্য করে তোলে তাকে বেসরকারি বিভিন্ন সেক্টরে বা বিদেশিদের সেবা করার জন্য কাজে লাগালে দেশের মানুষ তাদের কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেসরকারি চাকরির নিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবনার দাবি রাখে।
অনেকে আবার এমন যুক্তিও দিয়ে থাকেন যে, একসময় সেশন জটের কারণে পড়ালেখা শেষ করতে দেরি হলেও এখন তা হচ্ছে না বলে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবি অযৌক্তিক। এমবিবিএস এবং নার্সিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সাধারণ স্নাতক ডিগ্রির তুলনায় বেশি সময় লাগার কারণে ডাক্তার ও নার্সদের চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির জন্য আহুত যোগ্যতা স্নাতক ডিগ্রি একসময় তিন বছর মেয়াদি থাকলেও এখন তা চার বছর করা হয়েছে। অথচ স্নাতক ডিগ্রিধারীদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হয়নি। আর বিবিএসের মতো বহুল আকাক্সিক্ষত চাকরির পরীক্ষার নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ যেমনÑপ্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিক ও ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হতে যে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে তা আমলে নিলেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর যৌক্তিকতা উপলব্ধি করা যায়। এ দেশে প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শতাধিক নিয়োগ পরীক্ষার ভাইভায় অংশগ্রহণ করেও চাকরি না পাওয়ার অহরহ নজির রয়েছে। আর দীর্ঘ সময় নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রস্তুতি ছাড়া নিয়োগ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে পাস করা সম্ভব হলেও মেধা তালিকার প্রথম সারিতে না থাকতে পারায় স্বল্পসংখ্যক পদের জন্য যোগ্য হওয়া সম্ভব হয় না। তাই পরিস্থিতি স্বভাবতই বয়স বাড়ানোর ইঙ্গিত করছে। ভাবনার বিষয় হলো, ডিগ্রির স্কুলিং এবং ক্রেডিট বাড়ার কারণে শিক্ষাজীবন শেষ করতে আগের তুলনায় বেশি সময় প্রয়োজন হলেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সের ক্ষেত্রে কোনো যৌক্তিক পবিবর্তন আনা হয়নি।
চাকরির বয়সের সীমাবদ্ধতার সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি হলো মেধা পাচার। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা এবং নানা অব্যবস্থাপনার কারণে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যাওয়া তরুণদের একটি বড় অংশই আর দেশে ফেরে না। মেধা পাচারের এ ভয়াবহ দিকটি উপলব্ধি করে মালয়েশিয়া সরকার বিভিন্ন দেশে কর্মরত মালয়েশিয়ার নাগরিকদের দেশে আনার জন্য নানা সুবিধা প্রদানের নীতি গ্রহণ করলেও আমরা এ বাস্তবতা এখনও উপলব্ধি করতে পারছি না বা করছি না। ‘ট্যালেন্ট করপোরেশন’ শীর্ষক কর্মসূচির মাধ্যমে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তির বিদেশগামিতা শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনেছেন। যার ফলে মালয়েশিয়া উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক এ অঞ্চলে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে। আবার ৩০ বছর পূর্ণ হয়ে যাওয়ার ফলে দেশে কাক্সিক্ষত সরকারি চাকরি না পেয়ে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণই বিদেশে পাড়ি জমায়। বিদেশে পাড়ি জমানো তরুণরা বিভিন্ন উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের মাধ্যমে চাকরিদাতা দেশের স্বার্থে কাজ করে। কিন্তু দেশের জনগণ মেধাবী, দক্ষ ও ত্যাগী কর্মকর্তাদের মানসম্মত সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ বয়সসীমা শিথিল করে তরুণদের এ দেশে চাকরির সুযোগ করে দিলে এসব অভাবনীয় উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেত; যা বাংলাদেশকে মধ্যম ও উচ্চ আয়ের দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার অগ্রযাত্রায় সহায়ক ভূমিকা পালন করত। সুতরাং দেশের প্রশাসনিক কাঠামোকে মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতা ভিত্তিতে ঢেলে সাজানোর জন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর বিকল্প নেই।
গণমাধ্যমকর্মী
sakirahmaddu@gmail.com