Print Date & Time : 5 July 2025 Saturday 5:17 pm

সরকারের উদাসীনতায় উল্টো চোখ রাঙাচ্ছে আদানি !

বিশেষ প্রতিনিধি: আওয়ামী লীগের শাসনামলে লাইসেন্স দেয়া বড় সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পর্যালোচনায় ৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি করা হয়। অবসারপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ওই কমিটি সাড়ে পাঁচ মাসেরও প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। আবার চুক্তিগুলোয় প্রাথমিকভাবে বেশকিছু অনিয়ম পাওয়ায় তাদের সহায়তার জন্য একটি লিগ্যাল ও তদন্তকারী সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়ার সুপারিশ করেছিল কমিটি। তবে তিন মাস পেরুলেও বিদেশি এক্সপার্ট ফার্ম নিয়োগ হয়নি।
গত ২৬ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ সুপারিশ করে বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। এরপর প্রায় তিন মাস শেষ। তবে এখনও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ফার্ম নিয়োগ করা হয়নি। ফলে চুক্তির অনিয়ম বা সুপারিশ কার্যক্রম পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি। এ ছাড়া আদানির চুক্তি পর্যালোচনায় ১৯ নভেম্বর উচ্চ আদালত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জ্বালানি ও আইন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিলেও তার অগ্রগতি নেই।

তথ্যমতে, আদানির চুক্তিকে অবৈধ ঘোষণার দাবিতে গত নভেম্বরে একাধিক রিট মামলা দায়ের করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ নভেম্বর আদানি পাওয়ার (ঝাড়খণ্ড) লিমিটেডের সঙ্গে সরকারের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির তদন্ত করতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জ্বালানি ও আইন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ওই কমিটি নিয়োগ না হওয়ায় এটাকে আদালতের নির্দেশনার লঙ্ঘন বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে কমিটি গঠনের পর দুই মাসের মধ্যে হাইকোর্টে বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই সময়ের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের প্রক্রিয়া-সংক্রান্ত নথি দাখিল করতেও বলা হয়। একইসঙ্গে হাইকোর্ট আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা চুক্তি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে একটি রুল জারি করেছেন। এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশ দেয়ার জন্য চলতি বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করা হয়েছে। হাইকোর্টের আদেশের পর তিন মাসের পেরিয়ে গেলেও এখনও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ হয়নি। আর আদালতে এ ধরনের কোনো প্রতিবেদনও জমা দেয়া হয়নি।

জানতে চাইলে গত সপ্তাহে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে জানান, এখনও কোনো বিশেষজ্ঞ আইনজীবী বা আন্তর্জাতিক ল’ ফার্ম নিয়োগ করা হয়নি। তারা আরও বলেন, কমিটি যেসব অনিময় খুঁজে পেয়েছে তার ভিত্তিতে আরবিট্রেশন বা মামলায় যেতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে যাতে এগুলো ভ্যালিড হয়, তাই আন্তর্জাতিক আইন ও তদন্তকারী সংস্থাকে অবিলম্বে যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে এ ধরনের মামলা ও সহায়তার পূর্ব-অভিজ্ঞতা থাকাটা জরুরি। তবে এখনও সেটি করা হয়নি। এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। যদিও গত ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্সকে বিদ্যুৎ উপদেষ্টা বলেছিলেন, আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনা করবে বাংলাদেশ সরকার। তিনি সে সময় বলেন, ‘চুক্তিতে অসংগতি পাওয়া গেলে তা নিয়ে পুনরালোচনা করা হবে। দুর্নীতি বা ঘুষের মতো গুরুতর অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে চুক্তি বাতিল করা হবে।’

এদিকে তিন মাস বিরতির পর আগামী রোজায় বাংলাদেশকে পুরো সক্ষমতায় বিদ্যুৎ সরবরাহে সম্মত হয়েছে ভারতের আদানি পাওয়ার। তবে বাংলাদেশ বিদ্যুতের দামে যে ছাড় ও কর-সুবিধা চেয়েছিল তা প্রত্যাখ্যান করেছে আদানি। সম্প্রতি এ তথ্য জানিয়েছে রয়টার্স। যদিও আদানির বিদ্যুতের পুরোটা অর্থাৎ এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট পাবে না বাংলাদেশ। লোড টেস্টিংয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতা কম আসায় পরবর্তী পরীক্ষার আগ পর্যন্ত এক হাজার ৩৭৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেবে আদানি।

সূত্রমতে, বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধে বিলম্বের কারণে গত বছরের ৩১ আগস্ট গৌতম আদানির কোম্পানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে অর্ধেক করে দেয়। গত ১ নভেম্বর ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ইউনিট বন্ধ করে দেয় আদানি। শীত মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাবে, সে কারণে বাংলাদেশও বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেক কমিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদানি পাওয়ার বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেক কমিয়ে দেয়; সেই সঙ্গে মূল্য পরিশোধের বিষয়টি তো ছিলই।

যদিও গ্রীষ্ম মৌসুমের আগেই রোজার মধ্যেই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) অনুরোধে আগামী সপ্তাহ থেকে পুরো বিদ্যুৎ সরবরাহে সম্মত হয়েছে আদানি পাওয়ার। তবে বিদ্যুৎ সরবরাহে সম্মত হলেও আদানি পাওয়ার কয়লার মূল্য হ্রাস ও কর ছাড়সহ বাংলাদেশের অন্যান্য অনুরোধ মানতে রাজি হয়নি। দুই সপ্তাহ আগে আদানি পাওয়ারের সঙ্গে এ বিষয়ে ভার্চুয়াল বৈঠক হয় পিডিবির। এতে জানানো হয়, ‘আদানি পাওয়ার ছাড় দিতে রাজি নয়, এমনকি ১০ লাখ ডলারও নয়।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাড়া দেননি পিডিবির চেয়ারপারসন মো. রেজাউল করিম। এর আগে রয়টার্সকে তিনি বলেছিলেন, ‘আদানির সঙ্গে এখন আমাদের বড় কোনো সমস্যা নেই এবং তারা পুরো বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আদানি পাওয়ারের পাওনা পরিশোধের পরিমাণ মাসে সাড়ে আট কোটি ডলার থেকে বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে।’