সরকারের ঋণনির্ভরতায় বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা

নিজস্ব প্রতিবেদক: অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে অস্বাভাবিকভাবে। কিন্তু ঋণের সেই চাহিদা নেই। এজন্য ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৪৪ শতাংশের ওপরে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় সরকারের ঋণ বাড়বে। বেসরকারি বিনিয়োগ কম হওয়ায় অর্থনীতির প্রয়োজনে সরকার বিনিয়োগ বাড়াবে।

গতকাল চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু উচ্চাভিলাষী সরকারি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ধরা হলেও এ পরিমাণ বিনিয়োগ বাড়ানোর সক্ষমতা আছে কি না, সে বিষয়ে মুদ্রানীতিতে কিছুই বলা হয়নি।

অপরদিকে ব্যাংকগুলোর কাছে যাতে পর্যাপ্ত তারল্য থাকে, সেজন্য রেপো (পুনঃক্রয় চুক্তি) ও রিভার্স রেপোর সুদহার আরও এক দফা কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। মুদ্রানীতিতে রেপোর হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে চার দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। এক্ষেত্রে সুদহার ৭৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে চার শতাংশ করা হয়েছে।

এবারের মুদ্রানীতিকে সম্প্রসারণ ও সংকুলানমুখী হিসেবে অভিহিত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিবার সংবাদ সম্মেলন করে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলেও এবার মহামারির কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সাংবাদিকদের দাবি ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনের মতো জুম-মাধ্যমকে ব্যবহার করতে, যাতে সাংবাদিকরা মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের কৌশল সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু গভর্নর রাজি না হওয়ায় তা করা হয়নি।

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। আর সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, করোনাভাইরাস মহামারি, বন্যা, বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাভাব এবং আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতার ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে এ মুদ্রানীতি করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে, চলমান মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা এবং সরকার নির্ধারিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) এবং মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে আর্থিক খাতের সার্বিক ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করা।

‘সে হিসাবে নতুন মুদ্রানীতির ভঙ্গিকে স্পষ্টতই ‘সম্প্রসারণমূলক ও সংকুলানমুখী’ হিসেবে বিচেবনা করা যায়, যার মূল কাজ হলো মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে স্বাভাবিক করা, অর্থাৎ কভিড-১৯-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে আনা।’

চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে আট দশমিক দুই শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি পাঁচ দশমিক চার শতাংশে আটকে রাখতে চেয়েছে সরকার।

গত মুদ্রানীতিতেও (২০১৯-২০) বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক আট শতাংশ ধরা হয়েছিল। কিন্তু মহামারির ধাক্কায় এই প্রবৃদ্ধি এযাবৎকালের সর্বনি¤œ আট দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে গত ১০ বছরের বেসরকারি খাতে ঋণের তথ্য পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, গত অর্থবছরের মতো এত কম প্রবৃদ্ধি এক দশকে হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের ইতিহাসেই সর্বনিন্ম।

মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখা এবং কাক্সিক্ষত জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বাজারে মুদ্রা ও ঋণ সরবরাহ সম্পর্কে একটি আগাম ধারণা দিতে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিবছর মুদ্রানীতি প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়।

এবারও মতামত নেওয়া হয়েছে। তবে এবার উম্মুক্ত আলোচনা সভা করা যায়নি, এর পরিবর্তে মেইলে মতামত নেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক অর্থবছরে দুটি মুদ্রানীতি (জুলাই-ডিসেম্বর ও জানুয়ারি-জুন) ঘোষণা করে আসছিল। কিন্তু তার ‘বিশেষ তাৎপর্য’ নেই বলে গত ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে একটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছে।