ইসমাইল আলী ও মাসুম বিল্লাহ: কভিড-পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশের অর্থনীতি। রেমিট্যান্সে নিম্নমুখী গতি ও রপ্তানিতে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় এ সময় সবচেয়ে বেশি চাপে পড়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে রিজার্ভ কমছে দ্রুত। ফলে আমদানি নিয়ন্ত্রণে এলসি খোলায় নানা শর্ত আরোপ করা হয়। খোলাবাজারেও ডলার বিক্রি কমিয়ে দেয়া হয়। এতে পণ্য আমদানি ও বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে জটিলতায় সম্মুখীন হতে হয়।
যদিও বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণের প্রকৃত পরিমাণ কত, তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বৈদেশিক ঋণের ভিন্ন ভিন্ন হিসাব দিচ্ছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক বা ইআরডি কারোর হিসাবেরই মিল নেই। ফলে বিদেশি ঋণের বিপরীতে বছরে কী পরিমাণ কিস্তি পরিশোধ করতে হয় তার হিসাবেও দেখা দিয়েছে গরমিল।
সম্প্রতি ইআরডি প্রকাশিত ‘ফ্লো অব এক্সটার্নাল রিসোর্সেস ইনটু বাংলাদেশ ২০২১-২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি, কিস্তি পরিশোধসহ বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৬৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৫৫ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে গৃহীত বিদেশি ঋণের স্থিতি ২১ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ও বহুপাক্ষিক উৎস থেকে গৃহীত ঋণের স্থিতি ৩৩ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণকেই ইআরডি সরকারের নিজস্ব ঋণ হিসেবে দেখায়।
এর বাইরে সরকারের সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ সাত দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের ঋণ রয়েছে পাঁচ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। আর আইএমএফের ঋণ রয়েছে এক দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত এসব ঋণকে যদিও সরকারের নিজস্ব ঋণ হিসেবে চিহ্নিত করেনি ইআরডি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত জুনশেষে সরকারের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৬৯ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত ‘ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড এক্সটার্নাল ডেট জানুয়ারি-জুন ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, গত জুনশেষে সরকারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৫৭ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে গৃহীত বিদেশি ঋণের স্থিতি ২৪ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ও বহুপাক্ষিক উৎস থেকে গৃহীত ঋণের স্থিতি ৩৪ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।
এর বাইরে সরকারের সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১২ দশমিক ০১ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আইএমএফের ঋণ তিন দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে আইএমএফ বলছে, গত জুনশেষে সরকারের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৭২ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার। গত মাসে বাংলাদেশকে ঋণ অনুমোদনের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, গত অর্থবছর শেষে সরকারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৬৫ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে গৃহীত বিদেশি ঋণের স্থিতি ২১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ও বহুপাক্ষিক উৎস থেকে গৃহীত ঋণের স্থিতি ৩৪ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার।
এর বাইরে সরকারের স্বল্পমেয়াদি ঋণ রয়েছে দুই দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেও দেখানো হয়েছে। তবে ইআরডির হিসাবে স্বল্পমেয়াদি ঋণ দেখানো হয় না। এছাড়া সরকারের সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছয় দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। তবে সংস্থাটির নিজস্ব প্রদত্ত ঋণকে সভরেন গ্যারান্টিযুক্ত ঋণ না দেখিয়ে বহুপাক্ষিক উৎস থেকে গৃহীত ঋণ হিসেবে দেখিয়েছে আইএমএফ। এর পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৯৮৪ মিলিয়ন ডলার।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে আমদানি ও রপ্তানি হিসাবের একটি ব্যালান্স শিট থাকে। কিন্তু বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে ইনফ্লো ও আউটফ্লোর বিষয়ে তারা বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে না। এখানে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। আর সরকারের বিভিন্ন সংস্থার তথ্যের মধ্যে পার্থক্য থাকার বড় কারণ হলো, একেক সংস্থার তথ্য একেক সময় হালনাগাদ করা হয়। তবে বছর শেষে সব সংস্থার তথ্যের মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন হওয়া উচিত। কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না। এতে করে ঋণের সঠিক তথ্য সম্পর্কে এক ধরনের বিভ্রান্তি থেকেই যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ইআরডি থেকে সাধারণ ঋণের যে হিসাবটি দেয়া হয়, সে বিষয়ে সরকারের বৈদেশিক ঋণের একটি অংশের বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও বেসরকারি খাতের ঋণের জন্য প্রতি বছর কী পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয়, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পূর্ণাঙ্গ হিসাব করতে হলে কেবল ইআরডির মাধ্যমে সম্পাদিত চুক্তির বিপরীতে প্রাপ্ত ঋণ হিসাব করলে চলবে না। এর সঙ্গে সরকারের অন্যান্য সংস্থা ও বেসরকারি খাতের ঋণের পাশাপাশি যেসব বৈদেশিক অর্থায়নের বিষয়ে সভরেন গ্যারান্টি দেয়া আছে, সবগুলোকে হিসাব করতে হবে।
যদিও বৈদেশিক ঋণের সঠিক হিসাব না থাকায় বছরে কী পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে, তার সঠিক হিসাবও পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ইআরডির হিসাবে গত অর্থবছর বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল দুই দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আসল পরিশোধ করা হয় এক দশমিক ৫২৭ বিলিয়ন ডলার ও সুদ পরিশোধ করা হয় ৪৯১ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারের গ্যারান্টিযুক্ত ঋণ বিবেচনা করা হয়নি।
প্রকৃতপক্ষে গত অর্থবছর বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল চার দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে আসল পরিশোধ করা হয় তিন দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার ও সুদ পরিশোধ করা হয় ৬৫৬ মিলিয়ন ডলার।