ইসমাইল আলী: ২০০৯ সালের শুরুতে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার। এজন্য একের পর এক স্থাপন করা হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট। যদিও চাহিদা অর্ধেকেরও কম। আর লোকসানি বিদ্যুৎ খাতে প্রতি বছর বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে। পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে গৃহীত ঋণের জন্য সভরেন গ্যারান্টিও সরকারকে দিতে হয়েছে।
তথ্যমতে, গত ১২ বছরে সরকারি-বেসরকারি খাতে ১০০-এর বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এসব কেন্দ্রের মধ্যে সরকারি মালিকানায় বিভিন্ন কেন্দ্রের জন্য নেওয়া হয়েছে কঠিন শর্তের ঋণ। আর এসব ঋণের জন্যও সরকারকে দিয়েছে সভরেন গ্যারান্টি। বর্তমানে এর পরিমাণ প্রায় ৩৩ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা।
এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল আমদানিকারক বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বিভিন্ন দেশ থেকে কঠিন শর্তের ঋণে তেল আমদানি করে থাকে। এজন্য সরকারকে সভরেন গ্যারান্টি দিতে হয়। বর্তমানে এর পরিমাণ এক হাজার ১৯৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের বর্তমান সভরেন গ্যারান্টির পরিমাণ ৩৪ হাজার ৯৪০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আর সব খাত মিলিয়ে সরকারকে বিভিন্ন ঋণের বিপরীতে গ্যারান্টি দিতে হয়েছে ৬০ হাজার ৬৫৩ কোটি সাত লাখ টাকা। অর্থাৎ শুধু বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতেই সরকারের সভরেন গ্যারান্টি ৫৭ দশমিক ৬১ শতাংশ।
অর্থ বিভাগের মতে, সরকার বিভিন্ন সময়ে সরকারি নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের স্বার্থে সরকারি মালিকানাধীন আর্থিক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গৃহীত ঋণের জন্য গ্যারান্টি ও কাউন্টার গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। এসব ঋণের অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সময়মতো পরিশোধ করতে না পারলে তা পরিশোধের দায় সরকারের। তাই সরকারের ভবিষ্যৎ আর্থিক অবস্থার ওপর এর প্রভাব রয়েছে।
তথ্যমতে, বর্তমানে সরকারের সভরেন গ্যারান্টি সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ খাতে। এর মধ্যে ২০১২ সালে ২৭ ডিসেম্বর আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির ৪৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট (সিসিপিপি) প্রকল্পের জন্য প্রথম সভরেন গ্যারান্টি দেয় সরকার। প্রকল্পটির জন্য এইচএসবিসি থেকে দুই হাজার ৪৫৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়। পরের বছর ১৭ জানুয়ারি একই প্রতিষ্ঠানের ২২৫ মেগাওয়াট সিসিপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গ্যারান্টি দেওয়া হয়। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড গৃহীত এ ঋণের পরিমাণ ছিল এক হাজার ১৮৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
একই বছর ২৩ অক্টোবর চীনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কর্মাশিয়াল ব্যাংক থেকে কঠিন শর্তে (বায়ার্স ক্রেডিট) এক হাজার ১১২ কোটি ঋণ নেওয়া হয় ১৫০ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে। গাজীপুরের কড্ডায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যৌথভাবে নির্মাণ করে বিপিডিবি-আরপিসিএল (বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড)।
২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল এইচএসবিসির আয়োজনে সিন্ডিকেট ঋণ নেওয়া হয় বিপিডিবির শাহজিবাজার ৩৩০ মেগাওয়াট সিসিপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে। এক হাজার ৫৮৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকার এ ঋণেও সভরেন গ্যারান্টি দেয় সরকার। পরের বছর চারটি প্রকল্পে সভরেন গ্যারান্টি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৬ ফেব্রুয়ারি দুটি প্রকল্পে ঋণ দেয় আইসিবিসি ব্যাংক চায়না। এর মধ্যে বড়পুকুরিয়ায় ২৭৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের (৩য় ইউনিট) সম্প্রসারণের জন্য ঋণ নেওয়া হয় এক হাজার ৭৪৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা। আর ঘোড়াশালে ৩৬৫ মেগাওয়াট সিসিপিপি প্রকল্পে নেওয়া হয় এক হাজার ৭৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
এদিকে ২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর এইচএসবিসি থেকে নেওয়া হয় ৭১১ কোটি ১৩ লাখ টাকা ঋণ। এ অর্থে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১০০ মেগাওয়াট ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে বিপিডিবি। আর ১৫ নভেম্বর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড থেকে নেওয়া হয় এক হাজার ৩৫৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা ঋণ। এ অর্থে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি সিরাজগঞ্জে ২২৫ মেগাওয়াটের সিসিপিপি (দ্বিতীয় ইউনিট) ডুয়েল ফুয়েল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়।
পরের বছর ঘোড়াশাল তৃতীয় ইউনিট রি-পাওয়ার প্রকল্পেও এইচএসবিসি থেকে দুই হাজার ৩৯১ কোটি ১২ লাখ টাকা ঋণে সভরেন গ্যারান্টি দিতে হয়। একই বছর জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন থেকে ৪০০ মেগাওয়াটের বিবিয়ানা-৩ সিসিপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ঋণ নেওয়া হয়। এ কেন্দ্রটি নির্মাণে এক হাজার ৫৯৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়।
এর বাইরে ২০১৭ সালে তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সভরেন গ্যারান্টি দেয় সরকার। এর মধ্যে ১০ জানুয়ারি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড থেকে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি সিরাজগঞ্জে ২২৫ মেগাওয়াটের সিসিপিপি (তৃতীয় ইউনিট) ডুয়েল ফুয়েল কেন্দ্রের জন্য ঋণ নেওয়া হয় এক হাজার ৪৮৭ কোটি ২২ লাখ টাকা। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এক্সিম ব্যাংক অব ইন্ডিয়া থেকে নেওয়া হয় তিন হাজার ৯০২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। আর এক্সিম ব্যাংক অব চায়না থেকে নেওয়া হয় ১২ হাজার ৪৪৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ঋণ। এ অর্থে নির্মাণ করা হবে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
এদিকে বিপিসির জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ২০১৯ সালের ১৯ মে তিনটি সভরেন গ্যারান্টি দেওয়া হয়। এর পরিমাণ এক হাজার ১৯৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সভরেন গ্যারান্টি সরকারের আর্থিক ক্ষমতার ওপর চাপ তৈরি করে। আর বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাই বর্তমানে লোকসানে রয়েছে। তাই এসব প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সরকারের কাঁধেই এ ঋণ পরিশোধের দায় চাপবে। এছাড়া বর্তমানে চাহিদার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। তাই অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ করে সরকারের সভরেন গ্যারান্টি তথা আর্থিক চাপ কমানো উচিত।