পরামর্শ সভায় ইফতেখারুজ্জামান

সরকার পতনে জয়ী ভাবা অনেক দলের এজেন্ডায় রাষ্ট্র সংস্কার চিন্তা নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক: ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে নিজেদের জয়ী ভাবছে অনেক দল। অথচ এসব দলের এজেন্ডায় রাষ্ট্র সংস্কারের চিন্তা-চেতনা নেই বলে মন্তব্য করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিটির প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নতুন বাংলাদেশ গঠন নিয়ে যে সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সবাই এখন আশাবাদী। তবে তুমুল এ আন্দোলনের পর নিজেদের যারা জয়ী ভাবছেন, তাদের অনেকের
এজেন্ডার মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের চিন্তা-চেতনাটাও নেই। তাদের মধ্যে এখনও বিভিন্নভাবে বৈষম্য জিইয়ে রাখা বা প্রতিষ্ঠিত করার এজেন্ডা রয়েছে।’

রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে গতকাল শনিবার ‘নাগরিক সমাজ: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক জাতীয় পরামর্শ সভায় সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। দেশে কাজ করা তিন শতাধিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, নাগরিক সংগঠন ও প্ল্যাটফর্ম, নারী আন্দোলন, মানবাধিকার সংগঠন, সামাজিক উদ্যোক্তা এবং গবেষকদের ঐক্যজোট সিএসও অ্যালায়েন্স এ পরামর্শ সভার আয়োজন করে। বিগত সরকার এনজিওগুলোকে প্রচণ্ড চাপে রেখেছিল বলে অভিযোগ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দেশি-বিদেশি যে উন্নয়ন সংস্থাগুলো, তারা মূলত সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অনিয়ম-দুর্নীতি রুখতে কাজ করে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করে। অথচ গত ১৫ বছর এনজিও এবং সিএসও খাতের ওপর প্রচণ্ড ধরনের চাপ ছিল। হয়রানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করতে হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যে ক্ষমতার রাজনীতি, সেখানে এখনও যে সংকীর্ণতা; তাতে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে উন্নয়নমূলক কাজ করতে হয়। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তারাই আমাদের চরম শত্রু ভেবেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে অসহযোগিতা করেছে। আবার হয়রানির জন্য মিথ্যা মামলাও করেছে।’ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘যখন আবার সেই দল ক্ষমতার বাইরে থেকেছে; বিরোধী দলে গেছে, তখন আমাদের কর্মকাণ্ডগুলোকে সাধুবাদ জানিয়েছে। গত ১৫ বছরের যে ইতিহাস, সেখানেও কিন্তু ধারাবাহিক সেই প্রক্রিয়াই চলেছে। তাদের এমন কঠোরতা ও উদারতার কারণ হলোÑএকপক্ষের ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে এবং অন্যপক্ষকে ক্ষমতায় যেতে হবে।’ ‘অথচ অনিয়ম-দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সুশাসনের ঘাটতির যে চিত্র, তা তুলে ধরে এনজিও ও সিএসও খাতের সংস্থাগুলো মূলত সরকারকে সঠিক কাজটি করতে সহায়তা করে থাকে। সেটি কিন্তু গত সরকারগুলো অনুধাবন করতে পারেনি। ফলে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে’ যোগ করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
বিদেশি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে চাপে রাখতে সরকার আইনেও পরিবর্তন এনেছিল বলে উল্লেখ করে টিআইবির প্রধান বলেন, ‘বিদেশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে চাপে রাখার জন্য তারা আইনে নানা পরিবর্তনও এনেছিল। ফরেন ডোনেশন্স (স্বেচ্ছাসেবক অ্যাক্টিভিটিস) রেগুলেশন অধ্যাদেশ যেটি রয়েছে, ২০১৬ সালে তাতে ৪৩নং ধারা যুক্ত করা হয়। সেখানে ১৪ নম্বর উপধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি দেশের সংবিধান এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিদ্বেষমূলক ও অশালীন কোনো মন্তব্য করেন, তাহলে অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এর মাধ্যমে সংস্থাগুলোকে সমালোচনা, সুশাসন ও মানবাধিকার কথা বলার ক্ষেত্রে বাধার দেয়াল তুলে দেয়া হয়েছে।’

রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীকেও ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের চাপে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাও ব্যবহার করা হয়েছে। দফায় দফায় বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। বিদেশি অর্থায়ন রুখতে কাজ করা হয়েছে। নাগরিক অধিকার হরণের জন্যও ঠিক একইভাবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যক্তিগত কোনো দল, মত ও সংস্থাকে টার্গেট করে আমি এসব কথা বলছি না। ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে আমি বিষয়গুলো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।’
ক্ষমতায় গেলেই রাজনৈতিক দলের আচরণে পরিবর্তন আসে বলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘কোনো দল ক্ষমতায় থাকলে এক রকম, বাইরে থাকলে আরেক রকম যে ব্যবহার আমাদের সঙ্গে করা হয়েছে, সেগুলো মাথায় রেখে আমরা কাজ করেছি। তবে ছাত্র-জনতা যেভাবে সংগ্রাম করে একটি প্রেক্ষাপট আমাদের সামনে এনেছেন, সেই জায়গা থেকে এখন আমরা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। সংকীর্ণতা ও হয়রানি থেকে মুক্তির পথ খুঁজছি। নতুন এ বাংলাদেশে বেসরকারি সংস্থাগুলো নাগরিক সেবা দিতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। সেখানে নিরাপদে কাজ করার মতো একটি পরিবেশ আমরা প্রত্যাশা করছি।’

উন্নয়মূলক কাজ করতে নানা রকম বাধা-বিপত্তি এখনও রয়েছে বলে জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে থাকা উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অন্যতম কাজ। বাস্তবে আমরা সে কাজটা থেকে এখনও পিছিয়ে আছি। মানবাধিকার লঙ্ঘন, জেন্ডার বৈষম্য ও জাতিগত বিদ্বেষমূলক অপতৎপরতা ঠেকাতে যারা দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। এখন অনেক তথ্য পাচ্ছি, তারা কাজ করতে পারছেন না।’ ‘নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে বাধায় পড়ার ঘটনা সামনে আসছে। এক্ষেত্রে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আরও বেশি তৎপর হয়ে কাজ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে। তারপর নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারাও যেন সেই মূল্যবোধগুলো ধারণ করে উন্নয়নমূলক কাজ এগিয়ে নিতে পারেন, সেই পথ দেখিয়ে দিতে হবে’ বলেন দুদক সংস্কার কমিটির প্রধান।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিএসও অ্যালায়েন্সের আহ্বায়ক রাশেদা কে চৌধূরী। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন পানিসম্পদ এবং বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সমাজকল্যাণ এবং নারী ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখ।