মিজানুর রহমান: স্প্যানিশ লেখক ব্যালটাজার গার্সিয়ান বলেছেন, ‘যার হাতে কিছুই নেই, তার হাতেও সময় আছে এটাই আসলে বড় সম্পদ।’ তবে সেই সম্পদ তখনই বাস্তবতায় দৃশ্যমান হয় যখন মুক্ত পরিকল্পনা, মননশীলতা, ধৈর্য ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছায়। তেমনি অবসরকালীন পেনশন একটি অনন্য ব্যবস্থা, যার সারা পথে কাঁটা থাকলেও ফল হবে সুমিষ্ট মজাদার। এজন্যই হিসাব খোলা থেকে শুরু করে চাঁদা জমা পর্যন্ত প্রতিটি স্তর আরও সহজ, বাধাহীন ও ঝামেলামুক্ত করা প্রয়োজন।
এরই মধ্যে সরকার ১৭ আগস্ট বেসরকারি চাকরিজীবী ও ব্যক্তিপর্যায়ে চারটি স্তরে পেনশন সুবিধা চালু করেছে। আর তারই বাস্তবায়ন নির্ভর করে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকবেই, তবুও ব্যর্থতার তথাকথিত মানদণ্ডে পিছিয়ে যেতে চাই না। কেননা উন্নত দেশে এরকম পেনশন প্রথা বহু বছর আগে থেকেই চালু রয়েছে।
কয়েক দিন ধরে এই পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে বেসরকারি অফিসে ও বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকানে আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু আগ্রহী মানুষ হিসাব খুলে চাঁদার টাকাও জমা দিয়েছে। কেউ কেউ হিসাব খোলার অপেক্ষায় আছে এবং তার সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করছে।
শুধু তা-ই নয়, যারা জমা দিয়েছে তাদের কারও কারও মনে সন্ধিহান ও অবান্তর প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছেÑ‘ঠকলাম না জিতলাম? কীইবা হবে সুদূর ভবিষ্যতে? পদ্ধতিটা যে একেবারেই নতুন।’ এ প্রশ্নটা স্বাভাবিক, অবান্তর নয়। কারণ সরকারি পর্যায়ের পেনশন তুলতে নাজুক অবস্থা। আর বিগত বছরের টাকা পাচার, ঋণখেলাপি, আর্থিক তছরুপ ও অনিয়মের খবরে মানুষের টনক নড়েছে। স্বজন, শুভাকাক্সক্ষীরা জানতে চাচ্ছে, বুঝতে চাচ্ছে এবং পরোক্ষভাবে সমর্থন চাচ্ছে। এ আগ্রহটা ইতিবাচক আর জানা-বোঝাও তাদের অধিকার।
কিন্তু সমস্যা হলো তালিকাভুক্ত ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে আপাতত পেনশন কর্তৃপক্ষ সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, যার কারণে সোনালী ব্যাংকের হিসাবধারীরাই খরচ ছাড়া চাঁদা জমা দিতে পারছে। আর এ মুহূর্তে অন্য ব্যাংক থেকে টাকা জমা দেয়ার সুযোগও নেই।
সোনালী ব্যাংক ছাড়া অন্য যে মাধ্যমগুলো আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো মোবাইল ব্যাংকিং বা এমএফএস অথবা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার। হিসাব কষে দেখলাম এমএফএস ব্যবহার করে পাঁচ হাজার টাকার কিস্তি জমা দিতে গেলে বাড়তি মাসুল দিতে হয় কমপক্ষে ৪০ টাকা। উল্লেখ্য, বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়, সেলফিন, ওকে ওয়ালেট, এম ক্যাশ প্রভৃতিতে খরচের পরিমাণ একই রকম।
তবে দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের কার্ডের মাধ্যমে চাঁদার টাকা জমা দেয়ার ক্ষেত্রে খরচে ভিন্নতা আছে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের প্রোপাইটারশিপ নেক্সাস কার্ড ব্যবহার করলে পাঁচ হাজার টাকায় ফান্ড ট্রান্সফার ফি আসবে ৭৫ টাকা, ভিসা ও মাস্টার কার্ডে এটি ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা, আর আমেরিকান এক্সপ্রেস (এমেক্স) কার্ড হলে কেটে নেবে ১১২ টাকা ৫০ পয়সা। এই চ্যানেলে ২০-২৫ বছর পর্যন্ত জমা দিলে অযথাই অনেক বাড়তি খরচ বহন করতে হবে।
এই বাড়তি খরচ কাউকে করতে হতো না, যদি অন্যান্য ব্যাংকেও পেনশন কর্তৃপক্ষের হিসাব থাকত বা অন্য ব্যাংক থেকে অনলাইনে (বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক ফান্ডস ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক (বিইএফপিএন) টাকা স্থানান্তরের ব্যবস্থা থাকত। কারণ এই ব্যবস্থায় টাকা পাঠাতে কোনো খরচ হয় না। তাছাড়া কারও একটি হিসাব কোনো ব্যাংকে থাকলে সে নতুন করে আরেকটি হিসাব খুলতে অনীহা প্রকাশ করে।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় ভিন্ন মাত্রায় কোনো প্রচার দেখা যায়নি। অথচ সাধারণ জনগণের মাঝে খবরটি ঢালাওভাবে প্রচার করার প্রয়োজন ছিল। যদিও এখনও প্রচারের সময় ফুরিয়ে যায়নি। তবে সব ব্যাংকের অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজন খুব জরুরি।
বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকের দেশব্যাপী শাখা, উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং, পোস্ট ব্যাংকিং, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারসহ বিভিন্ন রকম বিজনেস সলিউশন রয়েছে। ব্যাংকিং সেবা থেকে দূরে আছে, এমন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যম হিসেবে তুরুপের তাস হতে পারে এজেন্ট ব্যাংকিং এবং সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দ্রুত অন্তর্ভুক্তি।
পেনশন যাতে টেনশনে পরিণত না হয় এবং জনগণের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেছেন, দেশের সরকার পরিবর্তন হলেও সর্বজনীন পেনশন স্কিম বা প্রথা চালু থাকবে। এখন দরকার ইতিবাচক প্রচারণা আর উল্লিখিত জনগণের অংশগ্রহণ।
সুতরাং আর সময় নষ্ট না করে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ সেøাগানের সঙ্গে মিল রেখে, বৃদ্ধ বয়সের দৃঢ়তা ও অবলম্বনের জন্য সর্বজনীন পেনশনের চাঁদা জমা ও গ্রহণের নিমিত্তে সহজ, খরচবিহীন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে সব চ্যানেল উš§ুক্ত করা প্রয়োজন। আর আমরা যদি সময়ের যতœ নিই, তাহলে সময়ও এক দিন আমাদের ঠিকই যতœ নেবে।
কর্মকর্তা, ব্যাংক এশিয়া