সর্বজনীন পেনশনে ইসলামি স্কিম যুক্ত হোক

খালেদ সাইফুল্লাহ : আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা শেষে তরুণ চাকরিপ্রত্যাশীদের বড় অংশের প্রথম পছন্দ সরকারি চাকরি। কারণ হলো চাকরি শেষে সারা জীবন নিরাপত্তা হিসেবে পেনশনের মতো সুবিধা এত দিন শুধু সরকারি চাকরিতেই ছিল। তবে মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল উন্নত দেশের মতো বেসরকারি খাতেও পেনশনব্যবস্থা চালুর। অবশেষে সরকারি সুবিধার মতো না হলেও নিজের জমানো টাকায় বহুল প্রত্যাশিত বেসরকারি খাতের সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি (স্কিম) প্রাথমিকভাবে পরীক্ষামূলক চালু করেছে সরকার।

সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আপাতত চার ধরনের স্কিম চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য প্রগতি স্কিম, প্রবাসীদের জন্য প্রবাস স্কিম, অনানুষ্ঠানিক খাত অর্থাৎ স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের জন্য সুরক্ষা স্কিম আর নি¤œ আয়ের মানুষের জন্য রয়েছে সমতা স্কিম।

অবশ্যই আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যত ভালো উদ্যোগ হোক না কেন ব্যবস্থাপনা ভালো না হলে তা মুখথুবড়ে পড়বে। সর্বজনীন পেনশন অবশ্যই চমৎকার উদ্যোগ তা বলার অপেক্ষা রাখে না; কিন্তু আমাদের জন্য নতুন হওয়ায় ইতোমধ্যে প্রকাশিত তথ্যগুলো থেকে অনেক প্রশ্নের জš§ দিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে এরকম উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কোনো কোনো দেশ এটার ভালো ব্যবস্থাপনা করেছে, আবার কোনো কোনো দেশ এ তহবিল থেকে অন্য কাজে টাকা খরচ করে পরে ঠিকমতো আর দিতে পারছে না তাই নাগরিকদের মনে শঙ্কাও রয়েছে। যেহেতু প্রাথমিকভাবে পরীক্ষামূলক চালু হয়েছে তাই এখন থেকেই নাগরিক ভাবনা তুলে ধরা দরকার। একই সঙ্গে সরকারকেও নাগরিক ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে হবে পরবর্তী ধাপে দেশব্যাপী বাস্তবায়নের আগে।

ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে বলতে হয়, সরকার ঘোষিত সর্বজনীন পেনশনের যে রূপরেখার কথা আমরা দেখেছি, তা কনভেনশনাল বিমার সাদৃশ্যপূর্ণ যা ‘গারার’ ও রিবা-নির্ভর। অর্থাৎ, একজন নাগরিক নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত নির্ধারিত হারে নিয়মিত অর্থ জমা দেবে, বিপরীতে শেষ বয়সে সরকার তাকে আমৃত্যু পেনশন দেবে। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দিয়ে সেই অর্থের বিনিময়ে অতিরিক্ত অর্থ পাওয়ার যে চুক্তি তা সুদের আওতায় পড়ে বলে প্রতীয়মান। এদেশের বেশিরভাগ মুসলমান সুদকে অপছন্দ করে। এ কারণে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর চেয়ে ইসলামি ব্যাংকগুলোয় সাধারণ গ্রাহকের অংশগ্রহণ বেশি। এছাড়া কনভেনশনাল ব্যাংকগুলোও গ্রাহক চাহিদার কারণে ইসলামি উইং খুলতে বাধ্য হচ্ছে।

এ অবস্থায় সাধারণ স্কিমের পাশাপাশি সুদমুক্ত একটা ইসলামি স্কিমও চালু করা হোক। এটি হবে সময়োপযোগী। যাতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে এবং সুদমুক্ত স্কিম চালু করা মোটেও কঠিন বিষয় নয়। সরকার আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নিলেই এটি সম্ভব। সরকারি চাকরিজীবী এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরতদের জন্যও সর্বজনীন পেনশনের দুটি স্কিম তৈরি করা হয়েছে বলে জানা গেছে, এ দুটি আপাতত চালু করছে না সরকার। তেমনি ইসলামি স্কিম যুক্ত করা হোক, এভাবে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা গেলেই কেবল সর্বজনীনতা পাবে পেনশন ব্যবস্থা।

বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের পথচলা শুরু ১৯৮৩ সালে। ৪০ বছরে ব্যাংকিংয়ের শরিয়াহভিত্তিক ধারাটি বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই এখন ইসলামি ধারার ব্যাংকিংয়ের আওতাধীন। বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ ধারার ১০টি ইসলামি ব্যাংকের পাশাপাশি প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোও যুক্ত হচ্ছে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং কার্যক্রমের সঙ্গে। বিশেষায়িত শাখা ও উইন্ডোর মাধ্যমে চালাচ্ছে ইসলামি ব্যাংকিং সেবা ও কার্যক্রম। বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা মোট ব্যাংক খাতের আমানতের ২৫ শতাংশের বেশি এবং বিনিয়োগের ২৯ শতাংশের বেশি শেয়ারের প্রতিনিধিত্ব করছে। মোট ব্যাংকগুলোর প্রবাসী আয়ের ৫৪.৭৬ শতাংশই ইসলামি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে। ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রমের এ হিসাব বলে দিচ্ছে সর্বজনীন পেনশনে ইসলামি স্কিমের চাহিদা বাস্তবসম্মত এবং সময়োপযোগী।

সত্যি বলতে প্রচলিত সরকারি পেনশন ও সার্বজনীন পেনশন এক নয়। আর্থিক সুবিধা ও ধর্মীয় বিবেচনা উভয় দিক থেকেই ভিন্নতা রয়েছে। প্রচলিত সরকারি পেনশন শরিয়াহ দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ। ফিকহী দৃষ্টিকোণ থেকে আলেমদের মতে, সেটি হয় চাকরিজীবীর সামগ্রিক চাকরির ওপর অতিরিক্ত পারিশ্রমিক অথবা চাকরির ওপর বিশেষ অনুদান। এর সঙ্গে পরিশ্রম জড়িত। পরিশ্রমের বিপরীতে প্রাপ্তি বলে সুদ বা হারামের সংশ্লেষ নেই। কিন্তু সার্বজনীন পেনশনে কোনো শ্রমের বিনিময় নেই এবং বিনিয়োগ বিষয়েও স্পষ্ট করে কোনো ধারণা নেই। আপাতদৃষ্টিতে সরাসরি টাকার বিপরীতে অতিরিক্ত টাকার আদান-প্রদান। যাতে সুদ, গারার, আল-আকলু বিল বাতিল প্রভৃতি ইসলামি শরিয়াহ নিষিদ্ধ উপাদান রয়েছে। এ বিবেচনায় ইতোমধ্যে আলেম সমাজ মতামত দিয়েছেন প্রচলিত পেনশন বৈধ হলেও সর্বজনীন পেনশনের এ পদ্ধতি ইসলামি  দৃষ্টিতে বৈধ নয়।

দেশের মানুষের মধ্যে বড় অংশই মুসলিম, ধর্মীয় অনুভূতি থেকেই মূলত তারা ইসলামী ব্যাংকগুলোয় যাচ্ছেন। বর্তমান সর্বজনীন পেনশনে সুদের কারণে দেশের উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় মানুষ এতে অংশগ্রহণে আগ্রহী হবে না। যেহেতু অন্যান্য মুসলিম দেশেও এ ধরনের মডেল রয়েছে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞ আলেমদের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি শরিয়াহসম্মত মডেল করা সম্ভব যা হবে ইসলামি স্কিম। ইসলামি স্কিম প্রণয়ন করলে সেটি জনপ্রিয়তা পাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া সর্বজনীন পেনশন প্রকৃত অর্থে ‘সর্বজনীন’ হয়ে উঠবে না।

শিক্ষার্থী, আইআইইউসি