নিজস্ব প্রতিবেদক: সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তারের বিরোধিতা করে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন সাংবাদিক ও নানা সামাজিক সংগঠন। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্বরে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত এক মানববন্ধন থেকে রোজিনার নিঃশর্ত মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও ‘দোষী’ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় গোপন নথি ‘চুরির চেষ্টার’ অভিযোগে গ্রেপ্তার সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ‘ফাঁসানো হয়েছে’ বলে দাবি করেছেন তার সহকর্মীরা।
সংগঠনের সভাপতি তপন বিশ্বাস মানববন্ধনে বলেন, ‘রোজিনা ইসলামকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, তাকে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে, এর বিরুদ্ধে আমরা আজকে মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছি। তার মুক্তি চাই, তার সঙ্গে যারা অন্যায় কাজগুলো করেছেন, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
তিনি বলেন, ‘আমার দুটি প্রশ্নÑপ্রথমত, অভিযোগ দিতে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছয়টি ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন। ছয় ঘণ্টা অপেক্ষা করার কারণটা কী? কী এমন অপরাধ করেছে সে? দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, রাষ্ট্রীয় গোপন নথি সে চুরি করেছে। কী এমন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ফাইল সেটা? বলা হচ্ছে, রাশিয়ার সঙ্গে ভ্যাকসিনের জন্য একটা এগ্রিমেন্ট হয়েছে। সেই এগ্রিমেন্ট হয়েছে ২২ এপ্রিল, কিন্তু ঘটনা ঘটেছে ১৭ মে। এত গুরুত্বপূর্ণ ফাইল সচিবের পিএসের টেবিলে পড়ে আছে!’
মন্ত্রণালয়ের ওই যুক্তি ‘কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়’ বলে মন্তব্য করে তপন বিশ্বাস বলেন, ‘এটা রোজিনাকে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র। রোজিনা ইসলাম নির্দোষ বলে মনে করি।’
বিএসআরএফ সভাপতি বলেন, রোজিনার মুক্তির দাবিতে তারা যে আন্দোলন করছেন, তা অব্যাহত থাকবে। প্রয়োজনে ‘আরও কঠোর কর্মসূচি’ তারা দেবেন।
এ দাবিতে একাত্মতা জানিয়ে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু মানববন্ধনে অংশ নেন।
এদিকে মামলা প্রত্যাহার করে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)।
গতকাল ডিআরইউর এক সমাবেশ থেকে সচিবালয়ে রোজিনাকে আটকে রেখে হেনস্তায় জড়িতদের শাস্তির দাবিও জানানো হয়।
দুপুরে ডিআরইউ চত্বরের এ সভায় নানা গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা উপস্থিত হয়ে সংহতি জানান।
রোজিনাকে গ্রেপ্তার করার প্রতিবাদে দেশ-বিদেশে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে ঢাকার প্রতিবেদকদের সংগঠন ডিআরইউও প্রতিবাদ সমাবেশ করল।
টেলিকম রিপোর্টার্স, বাংলাদেশের সভাপতি রাশেদ মেহেদী বলেন, ‘রোজিনা ইসলাম জেলে আছেন মানে আমরা সব সাংবাদিক জেলে আছি। আমরা ব্রিটিশ উপনিবেশ দেখিনি, পাকিস্তান উপনিবেশ দেখিনি, কিন্তু বাংলাদেশে এখন আমরা প্রশাসন ক্যাডারের উপনিবেশ দেখছি।’
‘ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি মাশহুদুল হক বলেন, ‘যে আইনে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, সামান্যতম ন্যায়বিচার হলেও তার জামিন সম্ভব। অবিলম্বে এই মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যেসব কর্মকর্তা রোজিনাকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করিয়ে দেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে ক্ষুণœ করেছেন, অবিলম্বে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’
অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজম জার্নালিস্টস ফোরাম বাংলাদেশের সভাপতি নাদিরা কিরণ বলেন, ‘রোজিনার ওপর যে নির্যাতন করা হয়েছে, সেটি নিঃসন্দেহে সাংবাদিকদের ওপরই নির্যাতনের শামিল। শুধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আন্দোলনকে চালিয়ে রাখা যাবে না। তার শুধু জামিনই নয়, বরং নিঃশর্ত মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।’
ইকোনমিকস রিপোর্টার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল হাসান বলেন, ‘এটি কেবল সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা নয়, এর মাধ্যমে সাংবাদিকদের তথ্য অধিকারের বিষয়টিকে ক্ষুন্ন করা হয়েছে।’
বরিশাল ডিভিশনাল জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিন আল রশিদ বলেন, ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস আইনে যে মামলা রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে করা হয়েছে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হতে পারে না। এই মামলার অর্থই হলো বাংলাদেশের কোনো সরকারি অফিসের দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে তথ্য দেয়া যাবে না। এই মামলার অর্থই হলো বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিক বলে কিছু থাকবে না।’
সমাবেশে সংহতি জানিয়ে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, ‘তথ্য গ্রহণ করা মানেই তথ্য চুরি নয়। রোজিনা যে তথ্য পেয়েছেন, সেটি ক্রসচেকের উদ্দেশ্যেই সেখানে গিয়েছেন।’
তারা বলেন, রোজিনাকে ‘শারীরিক নির্যাতনকারী’ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইনে মামলা দায়ের করা উচিত।
প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে উপস্থিত সাংবাদিকরা সচিবালয়ের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের কাছে রোজিনা ইসলামের মুক্তি এবং তার ওপর নির্যাতনকারীদের শাস্তির দাবিতে স্মারকলিপি দিতে যান।
এছাড়া রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়েছে পেশাজীবী সংগঠন ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইইবি)। আইইবির সম্মানী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. শাহাদাৎ হোসের শিবলু অবিলম্বে রোজিনার মুক্তি দাবি করেন এবং ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।