মো. আসাদুজ্জামান নূর: দেশের পুঁজিবাজারে গত সপ্তাহে বড় দরপতন দেখেছেন বিনিয়োগকারীরা। এতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন ১০ হাজার কোটি টাকা কমে গেছে। এর মধ্য দিয়ে টানা দুই সপ্তাহের পতনে ১৬ হাজার কোটি টাকা বাজার মূলধন হারিয়েছে ডিএসই। সেই সঙ্গে কমেছে সবকটি মূল্যসূচক ও লেনদেনের পরিমাণ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বিদায়ী সপ্তাহে বিনিয়োগকারীদের হতাশাবাদী মনোভাব ও আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রয় প্রবণতা পতনের মূল কারণ। তারা বলছেন, কয়েক সপ্তাহ পুঁজিবাজারে মুনাফা গ্রহণের পর ভালো শেয়ারে বিনিয়োগের সুযোগ নিতে বিনিয়োগকারীরা পোর্টফোলিও রিব্যালেন্সিং করেন। বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য বিনিয়োগকারীরা কিছুটা ‘সাইড লাইনে’ ছিলেন। এর কারণে বাজারের ওঠানামা ছিল।
পুঁজিবাজারের এমন ওঠানামার সঙ্গে গত সপ্তাহে পতনের পালে হাওয়া দেয় নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ও রিপোর্টিং-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ সার্কুলার। ১৫ ফেব্রুয়ারি জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ধারণকৃত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সব ধরনের শেয়ার, ডিবেঞ্চার, করপোরেট বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিট এবং পুঁজিবাজারের অন্যান্য নিদর্শনপত্রের হিসাব বাজার মূল্যে গণনা হবে। তবে নিজস্ব সাবসিডিয়ারি কোম্পানি, কোম্পানিগুলোকে প্রদত্ত ইক্যুয়িটি, দীর্ঘমেয়াদি ইক্যুয়িটি/ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি (বিডি) লিমিটেড ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর শেয়ার ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজার বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে না। পুঁজিবাজার কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়োজিত সাবসিডিয়ারি কোম্পানি ও সহযোগী কোম্পানিগুলোকে প্রদত্ত ঋণের স্থিতি, অপর কোনো কোম্পানি, স্টক ডিলারকে প্রদত্ত ঋণের স্থিতি, এবং তাদের সঙ্গে রক্ষিত তহবিলের স্থিতি (প্লেসমেন্ট বা অন্য যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন) এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে গঠিত কোনো তহবিলে প্রদত্ত চাঁদা এই হিসাবের বাইরে থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনা নিয়ে বাজার বিশ্লেষকরা ওই দিনই মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। যদিও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করা হোক। ওই নির্দেশনার পরের দিন বুধবার মিশ্র প্রবণতায় এবং বৃহস্পতিবার বড় পতন দেখা দেয় পুঁজিবাজারে। এর প্রভাবে সামগ্রিকভাবে ওই সপ্তাহেও নেতিবাচক ছিল বাজার।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ নেতিবাচক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনার ফলে শেয়ারবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সংকুচিত হয়েছে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্টদের ক্রয়মূল্যে গণনা করার দাবিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে। যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করে।
এর ধারাবাহিকতায় বাজারের ওঠানামা ও বিনিয়োগকারীদের সেই হতাশাবাদী মনোভাব নিয়ে শুরু হয় সদ্য সমাপ্ত সপ্তাহ। এই সপ্তাহে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কারণে চার কার্যদিবস পুঁজিবাজারে লেনদেন হয়। যার তিন কার্যদিবসেই পতন দেখা যায়। এর মধ্যে সর্বশেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবারেই ডিএসই সূচক কমেছে ১০৯ পয়েন্ট বা দেড় শতাংশের বেশি, যা চলতি বছরে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পতন। এদিন ইউক্রেনে সামরিক হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। এ হামলার খবরে আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রির কারণে এই পতন হয়।
এর কারণ হিসেবে মার্চেন্ট ব্যাংকার ও বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারের কারণে বিনিয়োগকারীদের হতাশাবাদী মনোভাব নিয়ে সপ্তাহটি শুরু হয়েছিল। শেষ দিনে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত করে। কারণ তারা ধরে নিয়েছিলেন, তেলের দামের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। এর সঙ্গে বড় ধরনের মুদ্রাস্ফীতি দেখা যেতে পারে। যার কারণে প্রচণ্ড বিক্রয় চাপে এক দিনেই ডিএসইর সূচক কমে একশ পয়েন্টের বেশি।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা, যা তার আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল পাঁচ লাখ ৬০ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই সময়ে বাজার মূলধন কমেছে ১০ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। আগের সপ্তাহে বাজার মূলধন কমে পাঁচ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। এ হিসেবে টানা দুই সপ্তাহের পতনে বাজার মূলধন কমলো ১৬ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা।
বাজার মূলধন বাড়া বা কমার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম সম্মিলিতভাবে ওই পরিমাণ বেড়েছে বা কমেছে। অর্থাৎ বাজার মূলধন বাড়লে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। একইভাবে বাজার মূলধন কমলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণ কমে যায়। ফলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পরিমাণ যে ওই সপ্তাহে কমেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাজার মূলধন কমার পাশাপাশি গত সপ্তাহে ডিএসইতে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমছে। সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া ৭৩টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বেড়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ২৯৭টির। আর ১৭টির দাম অপরিবর্তিত ছিল।
ফলে সাপ্তাহিক রিটার্নে দর কমেছে ২০ খাতেই। সবচেয়ে বেশি দর কমেছে সাধারণ বিমা খাতে। খাতটিতে ৪.৬ শতাংশ দর কমেছে। আর ট্যানারি খাতে ৪.৫ শতাংশ দর কমে তালিকার দ্বিতীয় ও আর্থিক খাতে ৪.৪ শতাংশ দর কমে তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এ ছাড়া অন্য খাতগুলোর মধ্যে আইটি ৪.১ শতাংশ, জীবন বিমা ৩.৬ শতাংশ, পাট ৩.৪ শতাংশ, সেবা-আবাসন ৩.৩ শতাংশ ও ব্যাংক খাতে দর কমেছে ২ শতাংশ। বাকিগুলো ২ শতাংশের নিচে ছিল।
এদিকে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১৫১ দশমিক ৯২ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ১৭ শতাংশ। আগের সপ্তাহে সূচকটি কমে ৯৪ দশমিক ৫৯ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। প্রধান মূল্যসূচকের পাশাপাশি গত সপ্তাহে কমেছে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক। গত সপ্তাহজুড়ে এই সূচকটি কমেছে ৫৮ দশমিক ৮৭ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ২৯ শতাংশ। আগের সপ্তাহে সূচকটি কমে ২৩ দশমিক ৬৪ পয়েন্ট বা দশমিক ৯১ শতাংশ। এ ছাড়া টানা দুই সপ্তাহ কমেছে ইসলামী শরিয়াহ্ ভিত্তিতে পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক। গেল সপ্তাহে এ সূচকটি কমেছে ৩২ দশমিক ৪২ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ১৫ শতাংশ। আগের সপ্তাহে সূচকটি কমে ৯ দশমিক ৪৭ পয়েন্ট বা দশমিক ৬২ শতাংশ।
এমন পতনেও সূচককে টেনে তোলার সর্বোচ্চ চেষ্টায় ছিল তিন কোম্পানির। ওই তিন কোম্পানির দর বৃদ্ধিতে সূচক বেড়েছে ৪ পয়েন্ট। কোম্পানিগুলো হলো: ড্রাগন সুয়েটার, রেনাটা এবং এডিএন টেলিকম লিমিটেড। এগুলোর মধ্যে ড্রাগন সুয়েটার অ্যান্ড স্পিনিং লিমিটেড ২.১০ পয়েন্ট, রেনাটা লিমিটেড ১ পয়েন্ট ও এডিএন টেলিকম লিমিটেড ০.৮০ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে।
গত সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে ডিএসইতে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৯৯৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয় এক হাজার ১৯৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কার্যদিবসে গড় লেনদেন কমেছে ১৯৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বা ১৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে তিন হাজার ৯৮৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয় পাঁচ হাজার ৯৬৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। সেই হিসাবে মোট লেনদেন কমেছে এক হাজার ৯৭৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা বা ৩৩ দশমিক ১৭ শতাংশ। মোট লেনদেন বেশি হারে কমার কারণ ২১ ফেব্রুয়ারির কারণে সপ্তাহে এক কার্যদিবস কম লেনদেন হয়।
সপ্তাহটিতে লেনদেনের শীর্ষে ছিল বিবিধ খাত। মোট লেনদেনের ১৩.২ শতাংশই ছিল খাতটির দখলে। আর ফার্মা ১২.৬ শতাংশ ও ট্যানারি খাতে ১১.৭ শতাংশ লেনদেনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এ ছাড়া ট্যানারি খাতে ১০.৭ শতাংশ, বস্ত্র খাতে ৯.৩ শতাংশ, খাদ্য খাতে ৭.৪ শতাংশ, ব্যাংক খাতে ৫.৫ শতাংশ লেনদেন হয়েছে। বাকি খাতের লেনদেন পাঁচ শতাংশের নিচে ছিল।
আলোচ্য সপ্তাহে ডিএসইর সার্বিক মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) কমেছে। আগের সপ্তাহের চেয়ে পিই রেশিও কমেছে শূন্য দশমিক ৩৬ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ১৫ শতাংশ। পিই রেশিও অবস্থান করছে ১৬ দশমিক ৩৪ পয়েন্টে। এর আগের সপ্তাহে ডিএসইর পিই রেশিও ছিল ১৬ দশমিক ৭০ পয়েন্ট।
খাতভিত্তিক হিসেবে পিই রেশিও বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাংক খাতের পিই রেশিও অবস্থান করছে ৭.৮ পয়েন্টে, সিমেন্ট ২২.২, সিরামিকস ৩২.৬, প্রকৌশল ২২.৫, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ২০.৮, খাদ্য ২৫.৪, জ্বালানি-বিদ্যুৎ ১২, সাধারণ বিমা ১৮.৭, আইটি ২৫, পাট ৪১৬.৯, বিবিধ ১২, মিউচুয়াল ফান্ড ৭.২, কাগজ ৩৪.৭, ওষুধ ১৬.৯, সেবা-আবাসন ১৮.৯, ট্যানারি ৫২.৫, টেলিকমিউনিকেশন ১৭.৯, বস্ত্র ১৭.৫ পয়েন্ট ও ভ্রমণ-অবকাশ খাতে পিই রেশি অবস্থান করছে ৫৯.৩ পয়েন্টে।