আল-আমিন কেমিক্যালের শেয়ার ক্রয়

সাকিবের নাম ভেঙে চলে কারসাজি!

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের ক্রিকেট অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের দুটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অংশীদারসহ আরও পাঁচ ব্যক্তি চলতি বছরের মে মাসে পুঁজিবাজারের ওটিসি মার্কেটে তালিকাভুক্ত আল-আমিন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের ৪৮ দশমিক ১৭৫ শতাংশ শেয়ার অধিগ্রহণ করার অনুমতি পেয়েছে। তবে কোম্পানিটি অধিগ্রহণে সাকিবের সহযোগী কোম্পানির অংশীদাররা থাকলেও এ বিষয়ে কিছুই জানেন না তিনি। একইসঙ্গে সাকিবের নাম ব্যবহার করে একদল শেয়ার কারসাজিকারী, যারা সব সময় শেয়ার কারসাজি করে থাকে এবং ওটিসি মার্কেটের কোম্পানি নিয়ে কারসাজি করে আসছে, সেইসঙ্গে বড় কিছু ব্যবসায়ী, নিয়ন্ত্রক সংস্থার একটি চক্র এবং হিরো ও মোনার্কের একাধিক পরিচালক সেই সুবিধা ভোগ করেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়।

সূত্রমতে, সাকিবের দুটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান মোনার্ক মার্ট ও মোনার্ক এক্সপ্রেস। এর মধ্যে মোনার্ক মার্টের পরিচালক জাভেদ এ মতিন আল-আমিন কেমিক্যালের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ২ দশমিক ৪০ শতাংশ শেয়ার ক্রয় করবেন এবং মোনার্ক এক্সপ্রেস থেকে প্রতিনিধিত্বের জন্য একজন ৪ দশমিক ৮০ শতাংশ শেয়ার ক্রয় করবেন। এছাড়া আমিনুল ইসলাম সিকদার এবং মো. খায়রুল বাশার (ইশাল কমিউনিকেশনের প্রতিনিধিত্বকারী) ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ, এএফএম রফিকুজ্জামান ১০ শতাংশ, মাশুক আলম ছয় শতাংশ, মো. হুমায়ুন কবির (লাভা ইলেকট্রোডস ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিনিধিত্বকারী) ২ দশমিক ৪০ শতাংশ এবং মুন্সী শফিউদ্দিন ৮ দশমিক ১৭৫ শতাংশ শেয়ার কিনবেন। এসব ব্যক্তি সাকিবের সঙ্গে ব্যবসায় অংশীদারিত্ব থাকার সুযোগ নিয়ে ওটিসির বন্ধ থাকা ‘আল-আমিন কেমিক্যাল’ আবার চালুর আশ্বাস ও নামমাত্র ব্যবসা শুরু করে শেয়ার নিয়ে বড় কারসাজির পরিকল্পনা করে রেখেছে হিরো ও বড় একটি চক্র এবং এর সঙ্গে খোদ বিএসইসির একটি চক্রও রয়েছে। যে বিষয়ে সাকিবের কোনো সম্পৃক্ততা বা জানা নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানানো হয়েছে।

সেইসঙ্গে আরও বিভিন্ন পর্যায়ে সাকিবের নাম ব্যবহার করে দুর্নীতি চলে। এর মধ্যে উল্লেযোগ্য হচ্ছে শেয়ার কারসাজি, যেখানে দেখা যাচ্ছে সাকিবের সঙ্গে ব্যবসা করা আবুল খায়ের হিরো ও তার সহযোগীদের একাধিকবার শেয়ার কারসাজির কারণে জরিমানা করেছে বিএসইসি। অথচ এ বিষয়ে সাকিবের বক্তব্য অনুসারে তিনি কিছুই জানেন না, যেখানে হিরো ও তার সহযোগীরা সাকিবের সঙ্গে ব্যবসার অংশীদার এবং চেয়াম্যানের দায়িত্বে থাকা সাকিবের ব্রোকারেজ হাউস মোনার্ক হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনার পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন হিরোর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, যিনি আবার মোনার্ক মার্ট ও মোনার্ক এক্সপ্রেসের একজন পরিচালক। ঠিক একইভাবে সাকিবের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্বে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে যোগসাজশের মাধ্যমে দুর্নীতি করছে বলে জানা যায়। সাকিবের নাম ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত চলে আসছে কারসাজি।

অস্ট্রেলিয়ায় টি-২০ বিশ্বকাপ খেলা চলমান থাকায় এ বিষয়ে জানতে সাকিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা স্বম্ভব হয়নি। তবে নাম না প্রকাশের শর্তে সাকিবের একান্ত ব্যক্তিগত একজন প্রতিনিধি শেয়ার বিজকে জানায়, সাকিবের যেমন একক মালিকানাধীন ব্যবসা রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে নানা ধরনের ব্যবসা করে থাকেন। আবার ব্যবসায় অংশীদার থাকা ব্যক্তিরা একাধিক ব্যবসায় সম্পৃক্ত থাকেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সাকিবের সঙ্গে ব্যবসা করেন এমন কয়েকজন কারসাজিকারী তার পরিচয় ও সুনাম কাজে লাগিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে স্বার্থ হাসিল করে চলেছেন। ফলে বিভিন্ন মহলে সাকিবকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হচ্ছে এবং তার সম্মান ক্ষুণœ হচ্ছে, যা নিয়ে সাকিব খুবই চিন্তিত বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে জানতে হিরোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, আল-আমিন কেমিক্যালের মোনার্ক মার্ট ও মোনার্ক এক্সপ্রেস শেয়ার ধারণ করবে। এবং এ দুটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দুই প্রতিনিধি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এবং কারসাজিতে সাকিবের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানতে চাইলে তার এ বিষয়ে কিছু জানা নেই বলে জানান।

এ বিষয়ে বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক শেয়ার বিজকে বলেন, আল-আমিন কেমিক্যাল ওটিসির মার্কেটের একটি বন্ধ থাকা কোম্পানি। কোম্পানিটি এসএমই মার্কেট আসে, তাহলে যে পরিমাণ কারসাজি হবে, তার থেকে বেশি হবে মূল মার্কেটে। যদি কোম্পানিটি ভালো কোনো গ্রুপ কিনে নিত, তবে আটকে থাকা বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো হতো। কিন্তু এখন যারা কিনছেন, তাদের হাতে গেলে বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কোম্পানির শেয়ার কারসাজির ফলে।

তিনি আরও বলেন, কোম্পানির শেয়ার কারসাজি চক্রের সঙ্গে ডিএসই বা বিএসইসির একটি চক্র জড়িত আছে বলে আমরাও জানতে পারি। সেক্ষেত্রে বিএসইসির উচিত বিষয়টি নজর দেয়া।

এর আগে আল-আমিন কেমিক্যালের উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাকিবের দুটি প্রতিষ্ঠান ও পাঁচ ব্যক্তির কাছে শেয়ার হস্তান্তরের অনুমোদন দেয়া হয়। তবে কোম্পানির সব শেয়ার স্থানান্তর কার্যকর করার পর অবিলম্বে সব শেয়ারকে ইলেকট্রনিক শেয়ারে রূপান্তরিত করতে হবে।

এদিকে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আশিক ১৮ দশমিক ৪০ শতাংশ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আতিকা ১৫ দশমিক ৯৭৫ শতাংশ ও তাজাক্কা তানজিম ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ শেয়ার ওই দুই প্রতিষ্ঠান ও পাঁচ ব্যক্তির কাছে বিক্রি করবেন বলে জানা গেছে।

বিএসইসির চিঠিতে বলা হয়েছে, আল-আমিন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের উদ্যোক্তা/পরিচালকদের মোট ২৪ লাখ আট হাজার ৭৫০টি শেয়ার, যা কোম্পানির মোট শেয়ারের ৪৮ দশমিক ১৮ শতাংশ চিঠিতে উল্লেখিত ক্রেতা ও কোম্পানির কাছে উল্লেখিত শর্তাবলি মেনে চলার সাপেক্ষে বিক্রি বা স্থানান্তর করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

তবে শর্ত হলো কোম্পানিটির উদ্যোক্তা/পরিচালকরা সম্মিলিতভাবে মোট শেয়ারের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করবেন। কোম্পানি নতুন শেয়ারহোল্ডারদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠন করবে, যারা কোম্পানিতে ন্যূনতম দুই শতাংশ বা তার বেশি শেয়ার ধারণ করবেন। পরিচালনা পর্ষদের পুনর্গঠন না হওয়া পর্যন্ত কোম্পানিটির আরও মূলধন বাড়ানোর অনুমতি নেই। প্রস্তাবিত শেয়ারের ক্রেতারা কোম্পানির উৎপাদন শুরু করবে। আর অধিগ্রহণ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে ব্যাংকিং কার্যক্রমসহ সব মুলতবি বিষয়গুলোকে নিয়মিত করবে। প্রস্তাবিত ক্রেতা/শেয়ারহোল্ডাররা কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কোম্পানিতে নতুন তহবিল বিনিয়োগ করবে। পৃথক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং তাদের বিপরীতে মূলধন প্রদান কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে হবে। আর কোম্পানির সব শেয়ার স্থানান্তর কার্যকর করার পর অবিলম্বে সব শেয়ারকে ইলেকট্রনিক শেয়ারে রূপান্তরিত করতে হবে।

প্রসঙ্গত, আল-আমিন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ বর্তমানে পুঁজিবাজারের ওটিসি একটি তালিকাভুক্ত। তবে সম্প্রতি বিএসইসি ওটিসি মার্কেট বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। তাই আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে কোম্পানিটিকে এসএমই প্ল্যাটফর্মে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। কোম্পানিটি ২০০২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে কোম্পানিটির মোট শেয়ারসংখ্যা ৫০ লাখ। এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে ৫০ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৪৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।