হামিদুর রহমান:জমির পরিমাণ দুই লাখ ১৭ হাজার ৭৭০ কাঠা, যাতে রয়েছে আবাসিক, বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক, শিল্প, পুনর্বাসন প্লট, টিন ও নিউক্লিয়াস বাড়ি। কিন্তু বেদখলে রয়েছে বিপুল পরিমাণ এই সম্পত্তি। এক-দুই বছর নয়, ৩৫ বছর ধরে এসব সম্পত্তি অবৈধ দখলে রয়েছে। এই সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। বেদখল এই সম্পদ থেকে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী বছরের পর বছর অবৈধ সুবিধা নিচ্ছে। মিরপুর হাউজিং এস্টেট এলাকায় বেদখল হওয়া এই সম্পত্তির মূল্য প্রায় সাড়ে ৫৪ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল কার্যালয়ের (সিএজি) কমপ্লায়েন্স অডিটে এই অনিয়ম উঠে এসেছে।
সূত্রমতে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের আওতায় বাস্তবায়নাধীন ও সদ্য সমাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্পের প্লট-ফ্ল্যাট বরাদ্দ-ব্যয় ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য হিসাবের ওপর ২০১৯-২০ অর্থবছরের কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে সিএজি কার্যালয়। পূর্ত অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষার আওতাধীন গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত বাজেট বরাদ্দের বিপরীতে সম্পাদিত কাজের রেকর্ডপত্র ও নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে পরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক অডিট করা হয়েছে। ৩০টি অডিট করা হয়েছে, যাতে আর্থিক অনিয়ম পাওয়া গেছে ৬৮ হাজার ৯৯৭ কোটি ৪৫ লাখ ৯ হাজার ৯৫৫ টাকা। এর মধ্যে মিরপুর হাউজিং এস্টেটে বেদখল হওয়া জমিতে সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫৪ হাজার ৪৪২ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা ডিভিশন-১-এর আওতায় মিরপুর হাউজিং এস্টেটের মিরপুর সেকশন-১, ২, ৩ , ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ ও ১১ এবং সেকশন-১২, রূপনগর সম্প্রসারণ দ্বিতীয় পর্ব ও বাস্তুহারা কোর হাউসে মোট জমির পরিমাণ তিন হাজার ৬১৫ দশমিক ৬৫ একর। এই জমিতে চার হাজার ৬১৯টি আবাসিক প্লট, ২২৬টি বাণিজ্যিক প্লট, ১২৬টি প্রতিষ্ঠানিক প্লট, ৩১৮টি শিল্প প্লট, দুই হাজার ৪৮০টি পুনর্বাসন প্লট, ছয় হাজার ৮৪০টি নির্মিত আধাপাকা টিনশেড বাড়ি, ১৪১টি অনির্মিত আধাপাকা টিনশেড বাড়ি ও ছয় হাজার ৮৫৬টি নিউক্লিয়াস বাড়ি রয়েছে। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০০০-এর ধারা ৭(চ) অনুযায়ী গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হলো তাদের জমির রক্ষণাবেক্ষণ এবং এই জমিতে বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্ল্যাট ও ইমারত নির্মাণ করা। এছাড়া আইনের ৭(ছ) মোতাবেক নির্মিত বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্ল্যাট ও ইমারতের বিক্রয়, ইজারা প্রদান বা অন্যভাবে বিলিবণ্টন করা। কিন্তু এই জমিতে গড়ে ওঠা প্লট বা বাড়ির মধ্যে কতটি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, কতটি বেদখল, তার কোনো তথ্য কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। এমনকি প্রতিটি প্লট বা বাড়ির জমির পরিমাণ কত, তারও কোনো তথ্য নেই গৃহায়নের কাছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত হারে গ্রাউন্ড চার্জ অর্থাৎ ভূমিকর আদায় করার কথা। কিন্তু কী পরিমাণ কর আদায় করা হয়েছে, তার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। যেহেতু কর্তৃপক্ষ এই আইন অনুযায়ী তার মালিকানাধীন জমির রক্ষণাবেক্ষণ ও বিলিবণ্টন-সংক্রান্ত তথ্যাদি সংরক্ষণ করেনি, এর ফলে এই গ্রাউন্ড চার্জ আদায় করা সম্ভব হয়নি। শুধু মিরপুর সেকশন-৮-এর ৪৭৪টি আবাসিক প্লটের বরাদ্দ তালিকা সরবরাহ করা হয়েছে। এই ৪৭৪টি আবাসিক প্লটের জমির পরিমাণ (দেড় কাঠার ১৩৭টি, দুই কাঠার ১৪৪টি এবং আড়াই কাঠার ১৯৩টি) ৯৭৬ কাঠা। অবশিষ্ট দুই লাখ ১৭ হাজার ৭৭০ দশমিক ৮২৫ কাঠা জমির বরাদ্দ দেয়া-সংক্রান্ত হিসাব পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ এই জমি বেদখল অবস্থায় রয়েছে বলে সিএজি’র অডিট রিপোর্টে উঠে এসেছে। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত রেট অনুযায়ী, মিরপুর এলাকার জমির সর্বনি¤œ মূল্য কাঠাপ্রতি ২৫ লাখ টাকা। এই হিসাবে এই দুই লাখ ১৭ হাজার ৭৭০ দশমিক ৭২৫ কাঠার মূল্য ৫৪ হাজার ৪৪২ কোটি ৭০ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা।
অপরদিকে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০০০-এর ধারা ৭(চ) এবং সরকারি এক আদেশ অনুযায়ী, সরকারি সংস্থার সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ, বিলিবণ্টন ও অবৈধ দখলমুক্ত করতে হয় এবং সরকারি জমির হাল নাগাদ ইনভেন্টরি করতে হয়। কিন্তু জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ মিরপুর হাউজিং এস্টেটের প্লট, বাড়ি ও জমির হালনাগাদ ইনভেন্টরি কখনও করেনি বলে অডিটে উঠে এসেছে। এ বিষয়ে জবাব চেয়ে চিঠি দেয়া হলেও কর্তৃপক্ষ কোনো জবাব দেয়নি। তবে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী অবৈধ সুবিধা নিয়ে এসব বাড়ি, প্লট ও ফ্ল্যাট রক্ষণাবেক্ষণ করেনি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্তব্যে অবহেলার কারণে সরকারি বিপুল পরিমাণ এই সম্পদ অবৈধ দখলে রয়েছে। গত ৩৫ বছর এই সম্পত্তি অবৈধ দখলে। কর্তৃপক্ষ অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ না করায় দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।
সরকারের বিপুল পরিমাণ সম্পদ অবৈধভাবে দখলে থাকলেও কেন উচ্ছেদ করা হয়নিÑএ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ঢাকা ডিভিশন-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী জোয়ারদার তাবেদুন নবী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ত্রিপক্ষীয় মিটিং হয়েছে। দ্রুত সময়ে কীভাবে সম্পদ নিষ্পত্তি করা যায়, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ চলছে। অনেক সময় মামলা থাকলে কাজে গতি কমে যায়। আমাদের এখন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নেই, কিছুদিনের মধ্যেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আসবে। তখন আমরা অভিযানে যাব।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিছু জায়গায় বিহারি থাকে। বিহারিদের জন্য আইনত কিছু বিষয় থাকে। তাদের পুনর্বাসন না হওয়া পর্যন্ত উচ্ছেদ করা যায় না। সবাইকে উচ্ছেদ প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।’