শেখ রিফাদ মাহমুদ: বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক প্রকার বিমা ভীতি রয়েছে। একশ্রেণির মানুষের কাছে কাছে বিমা মানেই প্রতারণা। অনেকে বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমবায় সমিতির মতো মনে করে। পত্রপত্রিকায় আমরা নিয়মিতই দেখতে পাই জনগণের সঞ্চিত অর্থ আত্মসাৎ করে তথাকথিত ভুঁইফোঁড় সমিতিরগুলো উধাও হওয়ার খবর। সাধারণ মানুষের কাছে বিমাও যেন সমিতির মতোই প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে বিমার সুবিধা সম্পর্কে সচেতনতা এবং বোঝার অভাব রয়েছে। অনেকে বুঝতে পারে না যে, বিমা কীভাবে কাজ করে বা কীভাবে এটি তাদের আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এসব কারণে অধিকাংশ মানুষ বিমা করতে দ্বিধাবোধ করে।
জনগণের বিমা কোম্পানির প্রতি আস্থার অভাবের কারণে তারা বিমা করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়। দেশে বিমা জালিয়াতি এবং অব্যবস্থাপনার ঘটনা ঘটেছে, যা জনগণের আস্থা নষ্ট করেছে। বেশিরভাগ জালিয়াতিগুলো হয়েছে মূলত বিমা কর্মীদের দ্বারা। গ্রাহকের প্রিমিয়ামের টাকা কর্মীরা সংগ্রহ করে কোম্পানিতে জমা না দিয়ে অনেক সময় নিজেরাই আত্মসাৎ করেছে। যার ফলে গ্রাহক হয়েছে প্রতারিত, দোষ হয়েছে বিমা কোম্পানির। বর্তমান সময় বিমা শিল্প ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আসায় এসব দুর্নীতি হ্রাস পেয়েছে। গ্রাহক নিজেরাই নিজেদের প্রিমিয়ামের অর্থ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করতে পারছে।
বাংলাদেশের মানুষের বিমা ভীতির অন্যতম কারণ হচ্ছে বিমা চুক্তি না বোঝা। অনেকে মনে করে যে কোনো অর্থ জমা করলেই সেটি উত্তোলন করা যায়। এ ক্ষেত্রে কিছু শর্ত রয়েছে, শর্ত না বুঝে অর্থ দাবি করলে সেটি গৃহীত হয় না। যার ফলে বিমার দুর্নাম হয়। কেউ কেউ দুই-এক কিস্তি প্রিমিয়ার জমার পরে আর বিমা চালান না। যার ফলে বিমা তামাদি হয়ে যায়। যেটির অর্থ গ্রাহককে প্রদানের সুযোগ থাকে না। যার ফলে গ্রাহকরা বিমা কর্মীদের বাড়িয়ে গিয়ে রূঢ় আচরণ করে থাকেন। বিমা কর্মীরা বিভিন্ন জায়গায় লাঞ্চনার শিকার হন। যেটি সারাদেশের চিত্র। যার প্রধান কারণ হচ্ছে, বিমা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, শর্ত না বোঝা এবং বিরূপ ধারণা।
একটা সময় ছিল, যখন সাধারণ মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পেত। ব্যাংকের পরিবর্তে আবাসস্থলের বিভিন্ন স্থানে গোপন জায়গা করে অর্থ সঞ্চিত করা হতো। মানুষের মনে এক প্রকার ধারণা ছিল ব্যাংক মানেই যেন প্রতারণা। ব্যাংকে অর্থ সঞ্চয় করলে হয়তো ব্যাংক সবকিছু নিয়ে পালাবে ঠিক এমনটাই ধারণা ছিল সাধারণ মানুষের মনে। পরে যখন দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকল, ব্যাংক কর্মকর্তারাও সাধারণ মানুষের দৌরগোড়ায় গিয়ে ব্যাংকের সুবিধা সম্পর্কে বোঝাতে থাকল। তখন মানুষ বেশ আগ্রহের সঙ্গে ব্যাংকমুখী হয়েছে। আর বর্তমানে সময় ব্যাংক ছাড়া তো আর্থিক লেনদেনের কল্পনাও করা যায় না। যদিও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অর্থ আত্মসাৎ কেলেঙ্কারির সংবাদও দেখা যায়। তবুও ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা বিন্দুমাত্র কমেনি।
বিমা বিভিন্ন কারণে বিতর্কিত হয়। বিমাকে ঘিরে সবচেয়ে সাধারণ বিতর্কগুলোর মধ্যে একটি হলো খরচ। কিছু লোক মনে করে যে বিমা প্রিমিয়মগুলো খুব বেশি। বয়স, স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং ভৌগোলিক অবস্থানের মতো কারণগুলোর ওপর নির্ভর করে বিমার খরচ ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, যা কিছু লোক বৈষম্যমূলক হিসেবে দেখে। বিতর্কের আরেকটি বিষয় হলো দাবি অস্বীকার। বিমা কোম্পানিগুলো বিভিন্ন কারণে দাবি অস্বীকার করতে পারে, যার মধ্যে অপর্যাপ্ত কাগজপত্র। এছাড়া বিমা কোম্পানিগুলো গ্রাহণের অর্থ প্রদানে বিলম্বিত করাও বিমা বিতর্কিত হওয়ার অন্যতম কারণ।
বিমা হলো একজন ব্যক্তি (পলিসিধারী) এবং একটি বিমা কোম্পানির মধ্যে একটি চুক্তি, যেখানে বিমা কোম্পানি প্রিমিয়াম প্রদানের বিনিময়ে কিছু আর্থিক ক্ষতির জন্য পলিসিধারককে ক্ষতিপূরণ দিতে চুক্তিবদ্ধ হন। উন্নত দেশগুলোতে বিমার ব্যবহার বেশ ব্যাপক। ইউরোপে বিমা জাতীয় পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, প্রতিটি দেশের বিমা কোম্পানি এবং নীতিমালার জন্য নিজস্ব নিয়ন্ত্রক কাঠামো রয়েছে। প্যান-ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা রয়ে?ছে; যেমন ইউরোপীয় বিমা এবং পেশাগত পেনশন কর্তৃপক্ষ (ঊওঙচঅ), যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন জুড়ে বিমা নিয়ন্ত্রণ এবং তত্ত্বাবধানে সমন্বয় করতে সহায়তা করে।
বিমার গ্রহণযোগ্যতা দেশ অনুসারে এবং বিমার প্রকারভেদে কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু দেশে, সরকার-প্রদত্ত স্বাস্থ্যসেবার জন্য পছন্দ থাকতে পারে, অন্যদের মধ্যে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বিমা। কিছু দেশে, জীবন বিমা এবং অবসরকালীন সঞ্চয় পণ্যের ওপর বেশি জোর দেয়া হয়। ইউরোপজুড়ে বিমা স্বীকৃত আর্থিক হাতিয়ার, যা ব্যক্তি এবং সংস্থাগুলোকে আর্থিক ঝুঁকি পরিচালনা করতে এবং অপ্রত্যাশিত ক্ষতির বিরুদ্ধে রক্ষা করতে সহায়তা করে।
বিমা বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক হাতিয়ার, যা ব্যক্তি এবং ব্যবসায়িকদের বিভিন্নভাবে সুরক্ষা প্রদান করে। বাংলাদেশে বিমা শিল্প বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যা ২০১০ সালে বিমা খাতের তত্ত্বাবধান ও তত্ত্বাবধানের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয?েছিল। আইডিআরএ বিমা কোম্পানির লাইসেন্স এবং নিয়ন্ত্রণ, বিমা পণ্য এবং পরিষেবাগুলোর জন্য নির্দেশিকা নির্ধারণ এবং নিয়ন্ত্রক প্রয়ে?াজনীয়তার সঙ্গে সম্মতি নিশ্চিত করার জন্য দায়ী।
বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের বিমা চলমান রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑস্বাস্থ্য বিমা, জীবন বিমা, ইসলামি শরিয়াহ বিমা, গাড়ি বিমা, ব্যবসায়ি?ক বিমাসহ বিভিন্ন ধরনের বিমা রয়ে?ছে। প্রতিটি বিমা ঝুঁকির বিষয়ে কভারেজ প্রদান করে। বিমার উদ্দেশ্য হলো অপ্রত্যাশিত ঘটনা বা পরিস্থিতির কারণে ঘটা আর্থিক ক্ষতি থেকে ব্যক্তি এবং সত্তাকে রক্ষা করা। উদাহরণস্বরূপ, গাড়ি বিমা দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে গাড়ির ক্ষতির জন্য কভারেজ প্রদান করতে পারে, স্বাস্থ্য বিমা চিকিৎসা ব্যয়ে?র জন্য কভারেজ প্রদান করতে পারে।
ব্যক্তি এবং ব্যবসা উভয়ে?র জন্যই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য বিমা অন্যতম হাতিয়ার। ক্ষতির কিছু ঝুঁকি একটি বিমা কোম্পানিতে স্থানান্তর করার মাধ্যমে ব্যক্তি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে তাদের সম্পদ রক্ষা করতে পারে। বিমা কভারেজ এক প্রকার মানসিক শান্তি প্রদান করতে পারে। কারণ এটি আর্থিক ক্ষতি সম্পর্কে চাপ এবং উদ্বেগ কমাতে পারে; যা ব্যক্তি এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কার্যক্রমে জোর দিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
সামগ্রিকভাবে, বিমা আর্থিক ঝুঁকি কমাতে এবং ব্যক্তি ও সংস্থাকে অপ্রত্যাশিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর্থিক সুরক্ষা প্রদান এবং দায়িত্বশীল আচরণের প্রচারের মাধ্যমে, বিমা আরও স্থিতিশীল এবং নিরাপদ আর্থিক ভবিষ্যতের জন্য অবদান রাখতে পারে।
কভারেজের পরিমাণ এবং বিমা প্রিমিয়ামের খরচ, বিমার ধরন এবং যে ব্যক্তি বিমা করছে তার চাহিদার ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। বিমা পলিসি নির্দিষ্ট চাহিদা এবং ঝুঁকি পূরণে সংযোজন-বিয়োজন করা যেতে পারে। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক ক্ষতির বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য বিমা একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার এতে সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের মানুষের বিমা বিমুখ হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, বিমা বিষয়ে ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে চলমান বিতর্ক। ইসলামিক স্কলারদের বিমা বিষয়ে? কোনো একক এবং সর্বজনস্বীকৃত দৃষ্টিভঙ্গি নেই। ইসলামিক অর্থনীতিতে কিছু সাধারণ নীতি রয়ে?ছে, যা বিমা-সংক্রান্ত আলোচনার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হলো রিবা বা সুদের নিষেধাজ্ঞা, যা ঋণের ওপর সুদ আদায় বা পরিশোধকে বোঝায়। কিছু ইসলামি স্কলাররা যুক্তি দেন যে প্রচলিত বিমাতে রিবা জড়িত, কারণ পলিসি হোল্ডাররা প্রিমিয়াম প্রদান করে; যা বিমা কোম্পানির দ্বারা বিনিয়ে?াগ করা হয়, একটি রিটার্ন লাভের প্রত্যাশায়। তারা বিশ্বাস করেন যে এটি একটি সুদভিত্তিক লেনদেন গঠন করে, যা ইসলামী অর্থে নিষিদ্ধ।
আবার অন্যদিকে কিছু ইসলামিক স্কলাররা বিমা সম্পর্কে অনুমোদনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেন, যুক্তি দেন যে এটি পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ঝুঁকি ভাগাভাগির একটি রূপ, যা ইসলামি আইনের অধীনে অনুমোদিত। তারা এই বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে যে বিমা অপ্রত্যাশিত ক্ষতির বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য সংস্থানগুলোকে একত্র করে এবং পলিসিধারীরা বিমা পুলের ঝুঁকি এবং সুবিধার অংশীদার হন। তবে এসব বিতর্কের জবাবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাকাফুল নামে পরিচিত বেশ কয়ে?কটি ইসলামি বিমা তৈরি হয়েছে। তাকাফুল হলো এক ধরনের সমবায় বিমা, যা ইসলামি নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে গঠন করা হয়েছে। পলিসি হোল্ডাররা অর্থ জমা রাখে, যা ক্ষতি পূরণ করতে ব্যবহƒত হয়। সামগ্রিকভাবে ইসলামি অর্থব্যবস্থায় বিমার অনুমোদনের বিষয়ে? কোনো সুস্পষ্ট ঐকমত্য না থাকলেও, ইসলামি নীতিমালা অনুযায়ী বিমা রয়েছে; যা শরিয়াহ সম্মত।
সামগ্রিকভাবে, বিমা আর্থিক ঝুঁকি পরিচালনা এবং অপ্রত্যাশিত ক্ষতির বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট প্রিমিয়াম প্রদান করে, আর্থিক সুরক্ষা এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনা বা ক্ষতির ক্ষেত্রে সুরক্ষিত থাকা যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, সরকার শিল্পের নিয়ন্ত্রণ এবং তত্ত্বাবধানকে শক্তিশালী করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। ভোক্তারা যাতে সুরক্ষিত থাকে এবং শিল্পটি যেন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হয় তা নিশ্চিত করার জন্য। বর্তমানে ১ মার্চ বিমা দিবস জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে বিমা গ্রহণ ও গ্রহণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ থাকলেও, এই শিল্পে প্রবৃদ্ধি ও বিকাশের সম্ভাবনাও রয়েছে। বিশেষ করে শরিয়াহসম্মত বিমাগুলোর ক্রমবর্ধমান গতিশীল হওয়া অন্যতম কারণ। জনগণের কাছে বিমার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ভালোভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে আরও আস্থা অর্জন করা সম্ভব। বিমা শিল্পে সরকারের আরও জোরালো নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান; বিমা শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মুক্ত লেখক