শেখ আবু তালেব: দেশের আরও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) অর্থ আত্মসাতের ঘটনা শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতি করেছে। তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাহমুদ মালিকের নেতৃত্বে এ অনিয়ম হয়েছে। এছাড়া আর্থিক খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এজন্য আজ মঙ্গলবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গঠিত তদন্ত কমিটি।
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় তার স্ত্রী ও বিএফআইসির সাবেক পরিচালক হাফসা আলমকেও ডেকেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত কমিটি। সুকুজা ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও তৎকালীন সময়ে দায়িত্বে ছিলেন হাফসা আলম।
সূত্রে জানা গেছে, হাফসা আলম ইতোমধ্যে গোপনে দেশ থেকে পালিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, মাহমুদ মালিকও যেকোনো সময়ে দেশত্যাগের পরিকল্পনা করছেন।
জানা গেছে, মাহমুদ মালিক বিআইএফসিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপরই তিনি ইডকল নামের রাষ্ট্রায়ত্ত আরেকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। গত ৩১ জুলাই তার মেয়াদ শেষ হয়। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক তার মেয়াদ আর বৃদ্ধি করেনি।
জানা গেছে, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিআইএফসি। এতে সংঘটিত আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি তদন্ত করতে নির্দেশনা দেন আদালত। এরপরই গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বিআইএফসির আর্থিক অনিয়মের ঘটনায় জড়িতদের দায়দায়িত্ব নির্ধারণে তদন্ত কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কমিটির নাম দেয়া হয় ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি’।
কমিটির প্রধান হচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর-৩ এ কে এম সাজেদুর রহমান খান। অন্য সদস্যরা হলেনÑকেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান, দুই মহাব্যবস্থাপক কবির আহমেদ ও নুরুল আমিন। সদস্য সচিব করা হয়েছে উপমহাব্যবস্থাপক সারোয়ার হোসেনকে।
কমিটিকে বিআইএফসিসহ একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্ত করতে বলা হয়। তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা চিহ্নিত করতে পেরেছে। এর আগে পিপলস লিজিংয়ের কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করে মামলাও হয়েছে। বাকি অভিযোগের বিষয়ে প্রমাণ সংগ্রহ চলছে। এরই মধ্যে বিআইএফসিতে সংঘটিত আর্থিক অনিয়মের অনেক ঘটনাই চিহ্নিত করতে পেরেছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, তদন্তের জন্য এর আগেও মাহমুদ মালিক ও তার স্ত্রী হাফসা আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি। সেই ধারাবাহিকতায় আজ ৩ আগস্ট ডাকা হয়েছে। কিন্তু স্ত্রী হাফসা আলম দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
সুকুজা ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন হাফসা আলম। বিআইএফসির শেয়ারহোল্ডার হচ্ছে সুকুজা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল। সুজার পক্ষে হাফসা আলম দীর্ঘদিন বিআইএফসির পর্ষদ সদস্য ছিলেন। এই সময়ে তিনি আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
হাফসা আলমের স্বামী মাহমুদ মালিক বিআইএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালে অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারিতে সহযোগিতা করেন। এজন্য এর আগেও এক দফায় হাফসা আলমকে ডেকেছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত কমিটি। এ-সংক্রান্ত এক চিঠিতে তাকে বলা হয়, এ বিষয়ে গতকাল রাতে শেয়ার বিজের সঙ্গে কথা হয় মাহমুদ মালিকের সঙ্গে। বাংলাদেশ ব্যাংক কেন তাকে ডেকেছেÑএমন প্রশ্নের উত্তরে মাহমুদ মালিক বলেন, ‘সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে বলব। আমি তো জানি না আমার কাছে কী জানতে চাইবে?’ তার স্ত্রী হাফসা আলম যাবেন কিনাÑএমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘না হাফসা আলম যাচ্ছেন না।’
সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করতে পেরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ দুর্নীতির সঙ্গে আলোচিত-সমালোচিত পিকে হালদারের নাম বেরিয়ে আসে সর্বপ্রথম। একাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে দশ হাজার কোটি টাকার অধিক পরিমাণের অর্থ নিয়ে দেশ থেকে পালিয়েছেন তিনি। এ দুর্নীতিতে মাহমুদ মালিকেরও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
বর্তমানে দেশে ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ১০টির আর্থিক অবস্থাই বেশ নাজুক। এর মধ্যে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) অন্যতম।
প্রতিষ্ঠানটি দেশের পুঁজিবাজারেও তালিকাভুক্ত। গত তিন বছর ধরেই প্রতিষ্ঠানটি কোনো আর্থিক বিবরণী প্রকাশ করছে না। এর আগে প্রকাশ করা আর্থিক বিবরণীতে ২০১৭ সালে লোকসান গুনেছে ৭০ কোটি, ২০১৬ সালে ৬৮ কোটি ও ২০১৫ সালে ৬২ কোটি টাকা লোকসান দেয়। সর্বশেষ বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দিয়েছিল ২০১৩ সালে। ওই সময়ে বিনিয়োগকারীদের ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। এরপর থেকে আর কোনো লভ্যাংশ দেয়নি বিআইএফসি।