বিশেষ প্রতিনিধি : ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এবার দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে সাউথইস্ট ব্যাংক। অভ্যন্তরীণ তদন্তে চুক্তিবহির্ভূত এক বিনিয়োগে অনিয়মের প্রমাণ পেয়ে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে ব্যাংকটি। অনিয়মের অভিযোগে এরই মধ্যে সাবেক চেয়ারম্যান ও এমডিসহ পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) লিখিত অভিযোগও করা হয়েছে।
ব্যাংকটির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এবং বর্তমান পরিচালক আলমগীর কবির, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম. কামাল হোসেন, ইনভেস্টমেন্ট ডিভিশনের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট জেসমিন সুলতানা এবং ইএম পাওয়ার লিমিটেডের প্রতিনিধি আনসার উদ্দিনসহ কয়েকজন জড়িত ছিলেন বলে তথ্য মিলেছে। যদিও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে চাননি সাউথইস্ট ব্যাংকের দায়িত্বশীলরা।
ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ডেপুটি অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তা খোরশেদ আলম চৌধুরীর স্বাক্ষরিত অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর ‘ইএম পাওয়ার লিমিটেড’ নামে একটি অখ্যাত ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির সঙ্গে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (প্রি-আইপিও) শেয়ার বিক্রির চুক্তি হয়। এই চুক্তি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই হয়; যা তৎকালীন চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের মৌখিক নির্দেশে ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম. কামাল হোসেনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় হয়। এতে ইনভেস্টমেন্ট ডিভিশনের সিনিয়র কর্মকর্তা জেসমিন সুলতানাও যুক্ত ছিলেন।
তথ্যমতে, চুক্তির আওতায় প্রতি শেয়ারে ১৫ টাকা করে মোট দেড় লাখ শেয়ার কেনা হয়, যার মধ্যে ১০ টাকা অভিহিত মূল্য ও পাঁচ টাকা প্রিমিয়াম ছিল। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর দুটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ইএম পাওয়ার লিমিটেডের ব্যাংক হিসাবে জমা দেয়া হয়। কিন্তু সাত দিনের মধ্যে এই টাকা ৯টি পৃথক চেকের মাধ্যমে অজ্ঞাত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়, যার কোনো তথ্য ব্যাংকের কাছে নেই।
প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনার চুক্তির শর্তানুযায়ী, কোম্পানিটির পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির আগেই ব্যাংককে বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কোনো লভ্যাংশ দেয়া হয়নি। এমনকি তালিকাভুক্তির উদ্যোগও নেয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ১৩টি চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে মূল বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত এলেও নির্ধারিত সাত কোটি ৫০ লাখ টাকা লভ্যাংশ ফেরত আসেনি।
এর আগে, গত ১০ মার্চ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ এ বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়-এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছিল না। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পূর্ব অনুমতি ছাড়াই প্রি-আইপিও শেয়ার কেনা হয়েছে। কোম্পানির সিআইবি রিপোর্ট ও নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বা প্রসপেক্টাসও যাচাই করা হয়নি। এমনকি চুক্তিতে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে স্বাক্ষরকারী আনসার উদ্দিনের পরিচয়ও যাচাই করা হয়নি।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, ইএম পাওয়ার লিমিটেড বিএসইসির কাছে আইপিও অনুমোদনের জন্য কোনো আবেদন করেনি এবং চুক্তির শর্ত ভেঙে ব্যক্তিস্বার্থে অর্থ আত্মসাৎ করেছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মতে, এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত প্রতারণা এবং আত্মসাতের ঘটনা, যেখানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যোগসাজশে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপব্যবহার করেছেন।
সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের রাজনৈতিক প্রভাবকেও এই দুর্নীতির পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে। আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ এই সাবেক চেয়ারম্যান বিগত সরকারের সময় রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় প্রভাব বিস্তার করেন। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন মহলের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি নানামুখী সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন।
ব্যাংকটির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গ্রাহকের অর্থ এবং আস্থা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সাউথইস্ট ব্যাংক। প্লেসমেন্ট শেয়ার জালিয়াতির ঘটনায় অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় প্রমাণ পাওয়া গেছে। অনিয়মের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কারণেই ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য করতে রাজি হননি ব্যাংকটির দায়িত্বশীলরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকটির এই পদক্ষেপ অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দৃঢ়তা এবং স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত। একইসঙ্গে অন্য ব্যাংকের জন্যও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা-অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পিছপা হওয়া যাবে না। জানা গেছে, ভবিষ্যতে এমন অনিয়ম ঠেকাতে সাউথইস্ট ব্যাংক নতুন বিনিয়োগ নীতিমালা প্রণয়নের কাজও শুরু করেছে।