মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে দুদকের চিঠি

সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে অবৈধ লেনদেনে ‘উমেদার’

নজরুল ইসলাম: সেবা দিতে তৈরি করা হয় নানা জটিলতা। বাধ্য করা হয় দালাল ধরতে। যার সুযোগ নিয়ে অবৈধ লেনদেনে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন অনেকে! সাব-রেজিস্ট্রার অফিস ও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে এসব ঘটনা ঘটছে। নিয়োগবহির্ভূত অনেক লোক রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে কাজ করেন, যাদের উমেদার (পিয়ন) বলে। অধিকাংশ অবৈধ লেনদেন তাদের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। গত ডিসেম্বরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো চিঠিতে স্বাক্ষর করেন দুদক সচিব মাহবুব হোসেন।

দুদক বলছে, সময়মতো ভলিউমে কপি না হওয়ার কারণে মূল দলিল সরবরাহ করতে বিলম্ব হয় এবং সার্টিফাইড কপি সরবরাহেও জটিলতার সৃষ্টি হয়। তাতে সেবাগ্রহীতা দালালের খপ্পরে পড়ছেন এবং দ্রুত সেবা পাওয়ার জন্য উৎকোচ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। দলিল রেজিস্ট্রেশনের সময় সরকারি রাজস্ব হিসেবে জমা হওয়া পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফ্ট, চেক প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হিসাবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমা হয় না। এতে এসব ব্যাংক ড্রাফ্ট, পে-অর্ডার, চেকগুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে খোয়া যাচ্ছে এবং জালিয়াতির মাধ্যমে এই অর্থ আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। জমি রেজিস্ট্রেশন হওয়ার সময় জমা হওয়া জাল পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফ্ট, চেক প্রভৃতি নির্ধারিত সময় ব্যাংকে জমা না দেয়ার কারণে ধরা পড়ছে না। পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফ্ট, চেক প্রভৃতি এন্ট্রি দেয়ার জন্য রক্ষিত রেজিস্টারের সব কলাম পূরণ করা হয় না। দলিল রেজিস্ট্রেশন হওয়ার পর নোটিশ সংশ্লিষ্ট এসি (ল্যান্ড) অফিসে পাঠানোর কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। দাতা-গ্রহীতার মধ্যে জমির প্রকৃত বিনিময়মূল্য বেশি হলেও তা দলিল লেখক ও সাব-রেজিস্ট্রারের সহায়তায় কম দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার কারণে প্রকৃত রেজিস্ট্রেশন ফি থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। নিয়োগ-বদলির ক্ষেত্রে ব্যাপক বাণিজ্যের জনশ্রুতি রয়েছে, আইন ও ম্যানুয়েল অনুযায়ী তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী বদলি, দলিল লেখক, নকলনবিস (এক্সট্রা মোহরার) নিয়োগের ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট জেলা রেজিস্ট্রারের; কিন্তু বাস্তবে এ নিয়োগ ও বদলি নিবন্ধন অধিদপ্তরের (আইজিআর) দপ্তর থেকে করা হয়। অনুসন্ধানকালে দেখা যায়, নিয়োগবহির্ভূত অনেক লোক রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে কাজ করেন, যাদের উমেদার (পিয়ন) বলে। অধিকাংশ অবৈধ লেনদেন তাদের মাধ্যমে হয়ে থাকে।

এসব দুর্নীতি প্রতিরোধে ১০ দফা সুপারিশ করেছে দুদক। মূল দলিল গ্রহীতাকে তাৎক্ষণিক ডেলিভারি দিতে তিন কপি দলিল সম্পাদন করে রেজিস্ট্রেশন করা যেতে পারে, যাতে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাতা ও গ্রহীতাকে এক কপি প্রদান করে এক কপি ভলিউমে উত্তোলনের জন্য সংরক্ষণ করা যায়। প্রতিটি দলিল ডেটাবেজে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। রেজিস্ট্রেশন ‘ফি’ হিসেবে প্রাপ্ত পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফ্ট, রেজিস্টারে এন্ট্রিসহ সময়মতো সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমা দেয়া এবং সিটিআর রিপোর্ট সংগ্রহ করা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

জমির হালনাগাদ খতিয়ানের কপি সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে সংরক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন এবং সে অনুযায়ী দলিল রেজিস্ট্রি করার আগে জমির মালিকানা-সংক্রান্ত বিষয় নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। আইন সংশোধনের মাধ্যমে জাল দলিল বাতিল ও সংশোধনের আপিল ও রিভিউ ক্ষমতা জেলা রেজিস্ট্রার ও তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (আইজিআর) আইনের দ্বারা কোনো অথরিটিকে দেয়া যেতে পারে।

কোনো দলিল রেজিস্ট্রেশনের কাজ শেষ হয়ে গেলে যদি সেটি জাল দলিল হিসেবে রেজিস্ট্রি হয়, তবে দেওয়ানি আদালত ছাড়া ওই দলিল বাতিল করা জমির প্রকৃত মালিকের পক্ষে সম্ভব হয় না, যা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। যদি এ ক্ষেত্রে আইন সংশোধনের মাধ্যমে আপিল ও রিভিউ ক্ষমতা জেলা রেজিস্ট্রার ও তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (এআইজিআর) আইনের দ্বারা কোনো অথরিটিকে দেয়া যায়, তাহলে দেওয়ানি আদালতে মামলাজট হ্রাস পাবে এবং জমির প্রকৃত মালিক দীর্ঘমেয়াদি বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাবে।

সম্পাদিত দলিলের দাতা/গ্রহীতা, দলিলের মূল্য ও জমির বিবরণের ডেটাবেজ তৈরি করা যেতে পারে। ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মৌজার গড় মূল্য সহজে পাওয়া যাবে এবং ক্রয়-বিক্রয় করা জমি সহজে চিহ্নিত করা যাবে।

সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সাব রেজিস্ট্রার অফিস একই কর্তৃপক্ষের অধীনে এনে একই কমপ্লেক্সে স্থাপন করা যেতে পারে, যাতে জমি রেজিস্ট্রেশন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নামজারি/জমাভাগের কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করা যায়।

দুর্নীতিমুক্ত জনসেবা নিশ্চিতকরণ ও সরকারি রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে রেজিস্ট্রি-কার্য সম্পাদনের সময় বিক্রীত জমির প্রকৃতি নির্ধারণ শেষে এর কপি সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমনÑনালা, চালা, ডোবা, নাল, ভিটি প্রভৃতি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভূমি জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃক জরিপ কার্য সম্পাদন রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স, ঢাকা-এর সব পর্যায়ে ডিজিটালাইজেশন/অটোমেশন পদ্ধতি চালু করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে পরামর্শ দেয়া যেতে পারে।

সাব-রেজিস্ট্রার ও স্টাফ বদলির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বদলির নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ছাড়া লটারির মাধ্যমে বদলির ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মহাপরিদর্শক, নিবন্ধন পরিদপ্তরকে পরামর্শ দেয়া যেতে পারে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রেজিস্ট্রি অফিসসমূহের পরিদর্শক (ঢাকা বিভাগ) আব্দুস ছালাম আজাদ বলেন, ‘আমার কিছু বলার নেই। মহাপরিদর্শকের সঙ্গে কথা বলুন।’

দুদকের অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করে নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (নিবন্ধন), সহকারী মহাপরিদর্শক (নিবন্ধন) এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহী বিভাগের রেজিস্ট্রি অফিসগুলোর পরিদর্শকের ইমেইল আইডিতে গত ১৮ জানুয়ারি এই প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে মেইল করা হয়। কিন্তু তারা কোনো মন্তব্য করেননি।