সাভার ও ধামরাইয়ের কর্মব্যস্ত মৃৎশিল্পীরা

বংশী নদীর তীরবর্তী সাভারের নলাম, শিমুলিয়া ও ধামরাইয়ের হাজীপাড়া, কাকরাইনসহ বিভিন্ন এলাকার কুমারপাড়াগুলোয় চলে মাটির তৈজসপত্র তৈরির কাজ। হাঁড়ি, কলসি, দইয়ের পাত্র, সানকিসহ নানা তৈজসপত্র তৈরির সময় কথা বলার ফুরসতও পান এখানকার মৃৎশিল্পীরা। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে এ ব্যস্ততা যেন আরও বেড়ে যায়।
নলাম এলাকার কুমারপাড়ায় পৌঁছাতেই চোখে পড়ল কুমারদের কর্মযজ্ঞ। কুমার পরিবারের সবাই ব্যস্ত নিজ কাজে। পরিবারের ছোট্ট শিশুটিও কাদার বালতি মাথায় নিয়ে ছুটছে এদিক-সেদিক। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটিও সহায়তা করছেন এই কাজে। এঁটেল মাটি পা দিয়ে মাড়িয়ে পাত্র তৈরির জন্য উপযোগী করছেন কেউ। তারপর মাটির তৈরি এসব তৈজসপত্র রোদে শুকিয়ে বিশেষ চুল্লিতে (পুঁইন) পোড়ানোর জন্য প্রস্তুত করার কাজও চলছে একযোগে।
কুমারপাড়ার অখিল পাল ও তার স্ত্রী রঙ্গি রানী পালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় মাটির তৈজসপত্র তৈরি করছেন তারা। তারা বলেন, মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা থাকায় পরিবারের ছোট থেকে বয়োবৃদ্ধদের সাহায্য নিতে হয়।
পাশের বাড়ির অনন্ত পাল ও শিমা রানী পাল জানান, মাটির পাত্র তৈরি করতে উপযোগী হিসেবে এঁটেল মাটির ব্যবহার করেন তারা। কুমারপাড়া থেকে কয়েক মাইল দূরে নিজের জমির মাটি বিক্রি করেন জহর উদ্দিন। তার কাছ থেকে নদীপথে ট্রলারপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা দরে মাটি কিনে আনেন এই পাড়ার কুমাররা। পরে সেই মাটিকে পানির সংমিশ্রণে পা দিয়ে মাড়িয়ে পাত্র তৈরির উপযোগী করা হয়। এরপর মাটি প্রয়োজনমতো কেটে হুইল মেশিন অথবা হাতে বানানো হয় চাহিদামতো বিভিন্ন তৈজসপত্রের আকার। সবশেষে রোদে শুকিয়ে তা বিশেষ চুল্লিতে (পুঁইন) এক সপ্তাহব্যাপী পুড়িয়ে বাজারজাত করা হয়। এই দম্পতি আরও বলেন, তাদের তৈরি এসব তৈজসপত্র রাজধানী ঢাকা, বগুড়া, সিলেট ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায়। পাইকাররা হাঁড়িপ্রতি মজুরি হিসেবে তাদের সাত টাকা দেয়। বাজারে তা বিক্রি হয় দশ টাকার ওপরে।
বিলুপ্তপ্রায় এই কুমার পেশা ছেড়ে কাঠমিস্ত্রির কাজ করছেন এই গ্রামের এমন একজন রামা সূত্রধর। তবে তার স্ত্রী সূমি সূত্রধর বছরের বিভিন্ন সময় অন্যের বাড়িতে চুক্তিভিত্তিক মৃৎশিল্পের কাজ করেন। সুমি সূত্রধর বলেন, একশ’ হাঁড়ি তৈরি করার পর ৫০ টাকা পান। তিনি প্রতিদিন প্রায় ছয়শ হাঁড়ি তৈরি করতে পারলে দিনশেষে তিনশ’ টাকা বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন। এই কাজের জন্য পা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ হুইল মেশিন চালাতে হয়।
কুমারপাড়ায় বংশ পরম্পরায় এই পেশার সঙ্গে জড়িত রণজিৎ কুমার পাল বলেন, আগে এই গ্রামের সবাই মৃৎশিল্পের কাজ করত, কিন্তু এখন প্লাস্টিকের তৈরি আসবাব ও বিভিন্ন খেলনাজাতীয় জিনিসে বাজার সয়লাব হয়ে যাওয়ায় এই পেশা ছেড়ে দিয়েছে অনেকে। বর্তমানে তাদের গ্রামের শুধু ২০ থেকে ৩০টি পরিবার এই পেশায় জড়িত। তাই বাংলার বিলুপ্তপ্রায় এই ঐতিহ্যবাহী পেশাকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার দরকার বলেও জানান তিনি।
নবীনগর জাতীয় স্মৃতিসৌধসংলগ্ন মৃৎ ও কুটিরশিল্প বাজারের দোকানি রিপন পাল বলেন, প্রতি বছর বিভিন্ন উৎসব-পার্বণ ঘিরে তাদের দোকানে মাটির তৈরি জিনিসের বিকিকিনি বেড়ে যায়। তখন কুমারপল্লিগুলো থেকে কিনে আনা মাটির হাঁড়ি, খেলনা ও ফুলের টব রঙের আঁচড়ে সাজিয়ে তুলতে ব্যস্ত থাকেন তারা।

ইমতিয়াজ উল ইসলাম