খন্দকার রাহাত মাহমুদ: আমাদের সমাজে যাদের অর্থের প্রাচুর্য আছে, প্রচুর সম্পদ আছে তারা প্রচুর ক্রয় করছেন। ধনিকশ্রেণির এমন ক্রয়কার্য দেখে নিম্নআয়ের বা নিচু শ্রেণির মানুষের সমস্যা হচ্ছে। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রেণিবিভাজন অবশ্যম্ভাবী। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানের কাছে কোনো পণ্যের মূল্য বেশি হলেও সহজলভ্য হচ্ছে নিম্নবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা সন্তানের ক্ষেত্রে ওই পণ্য ক্রয় হয়তো কল্পনার সমতুল্য হচ্ছে, কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উচ্চবিত্তের বেলায় অপচয়টা আরও বেশি হচ্ছে। বাজার থেকে তারা অনেকেই খাবারের জন্য কোনো কিছু কিনে এনে কোনো কারণে তা পছন্দ না হলে ফেলে দিচ্ছেন।
আমরা প্রাচুর্যময় দুনিয়ায় বাস করছি। বলা হচ্ছে, সারা বিশ্বে খাদ্যের যে উৎপাদন তা চাহিদার তুলনায় বেশি; অথচ বিশ্বে ৯০ কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে, খর্বাকৃতি মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, অপুষ্টির কারণে শিশুর যে বৃদ্ধি হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। পৃথিবীর বুকে মাথা রেখে প্রতি সাতজনের একজন ক্ষুধার্ত পেটে ঘুমিয়ে পড়ছে। প্রতি ১০ নারীর মধ্যে সাতজনই ভুগছে অপুষ্টিজনিত রক্তস্বল্পতায়। জঠরের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ২০ হাজার শিশু মারা যাচ্ছে প্রতি বছর। সারা বিশ্বে খাদ্য উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ ভূমি ব্যবহার করা হয়, তার প্রায় ২৫ শতাংশ বাসযোগ্য। যে পরিমাণ পানি আমরা ব্যবহার করে থাকি তার প্রায় ৭০ শতাংশ লেগে যায় খাদ্য উৎপাদন করতে। ৮০ শতাংশ অরণ্যই ধ্বংস হয় খাদ্য উৎপাদনের কারণে। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক সংগঠন ওয়াটার ফুট প্রিন্ট এক সমীক্ষায় বলেছে, এক লিটার দুধ উৎপাদনের জন্য এক হাজার বিশ লিটার পানির ব্যবহার হয়ে থাকে। এক লিটার দুধের অপচয় মানে এক হাজার বিশ লিটার পানির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদার্থ অপচয় করা। শুধু কি তাই, ওই এক লিটার দুধ বোতলজাত বা প্যাকেটজাত করতে যে মেশিনপত্র ব্যবহার করা হয়, সংরক্ষণের জন্য যে রেফ্রিজারেটর ব্যবহার হয়, পরিবহনের জন্য যে ট্রাক, লরি বা ট্রেন ব্যবহার হয়, তা যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য অপচয়ের মাধ্যমে আমরা কী পরিমাণ শক্তির অপচয় করছি তা বোধ হয় হিসাব করা কঠিন। সংরক্ষণ বা পরিবহনের জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে, তা থেকে নির্গত পদার্থ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। সুতরাং অপচয়ের পরিবেশগত সমস্যাটাও কোনো অংশে কম নয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এক প্রতিবেদনে বলেছে, খাদ্য অপচয়ের কারণে বছরে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি ডলার। সংস্থাটির গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বে বছরে প্রায় ১৩০ কোটি টন খাদ্য নষ্ট হয়, যা মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এফএও’র মহাপরিচালক হোসে গ্লাসিয়ানো ডি সিলভা বলেছেন, ভোক্তারা প্রতিদিন বিশেষ করে ধনী দেশগুলোতে যে বিপুল খাদ্য নষ্ট করেন, তা পুরো সাবসাহারা অঞ্চলে উৎপাদিত খাদ্যের সমান। খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই বিশ্ব বিনির্মাণে খাদ্যের এই অপচয় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। খাদ্য অপচয় যদি কমানো যায়, তাহলে একদিকে যেমন খাদ্য উৎপাদনের ওপর চাপ কমে যাবে, তেমনি সরবরাহ বাড়বে। মিস্টার ডি সিলভা জানান, বিশ্বে বসবাসকারী মানুষের কিছু আচরণের কারণে যে পরিমাণে খাদ্য অপচয় হয় তা সুইজারল্যান্ডের সারা বছরের মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির সমান। বিশ্বে যেসব মাছ ও সামুদ্রিক খাদ্য নষ্ট হয়, সেগুলো এবং অপচয় হওয়া খাদ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য ব্যয় নাকি এ হিসাবের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ভাবুন তাহলে অপচয়ের কী অবস্থা! অথচ বিশ্বে দৈনিক ১৭ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। ‘ফুড ওয়েস্টেজ ফুটপ্রিন্ট: ইমপ্যাক্ট অন ন্যাচারাল রিসোর্সেস’ নামক প্রকাশনায় বলা হয়, প্রতিবছর যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনের পর না খেয়ে নষ্ট করা হয়, তা পচে যাওয়ার পর সেখান থেকে যে পরিমাণ তরল পদার্থ তৈরি হতে পারে, তা ভলগা নদীর পানিপ্রবাহের সমান। খাদ্যের অপচয় শুধু খাদ্য বা অর্থের ওপরই প্রভাব ফেলছে, তা নয়। খাদ্যের অপচয়ের কারণে পরিবেশের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এতে বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অনেক প্রাণীর স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে।
আমরা আমাদের পরিবার, রেস্তোরাঁ, ক্যান্টিন, সুপার মার্কেট, পর্যটন খাত প্রভৃতি যেসব জায়গায় খাদ্য তৈরি, বিক্রি বা গ্রহণ করে থাকি সেখানেই খাদ্যের অপচয় করছি; অথচ এসব জায়গাতেই আমরা অপচয় রোধে বড় ভ‚মিকা রাখতে পারি। খাদ্যের অপচয়ের কারণে বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, সে প্রবণতাকে আমরা সচেতন হলে বিপরীতমুখী করতে পারি।
দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এটি একটি অপব্যবস্থা ও অপসংস্কৃতি। দুর্নীতির কারণে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। দুর্নীতির কারণে জনগণ সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি আর্থিকভাবে লাভবান হয়। রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে দুর্নীতি এক ধরনের অপরাধ। কেউ দুর্নীতি করলে এবং তা প্রমাণ হলে তার জন্য শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু অপরাধের যে সংজ্ঞা তাতে অপচয় ও অপব্যয় অপরাধের মধ্যে সম্ভবত পড়ে না। অথচ অপচয় ও অপব্যয় একটি দেশকে ঘুণপোকার মতো ভেতর থেকে ক্ষয় করে দেয়, যা সহজে চোখে পড়ে না। দুর্নীতির সঙ্গে অপচয় রোধ করতে না পারলে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। ক্রয়ের সামর্থ্য থাকলেই যে অপচয় করতে হবে, তা নয়। অপচয় অনৈতিকতার চর্চাকে শক্তি জোগায়।
দেশে লোডশেডিং হচ্ছে; অথচ অনেক অফিস আছে যেখানে সন্ধ্যার পর থেকে সারা রাত দপদপ করে অনাবশ্যক বিদ্যুৎবাতি জ্বলছে। বিদ্যুতের অভাবে লোডশেডিং করতে হলেও অফিসগুলোতে অনায়াসেই হচ্ছে বিদ্যুতের অপচয়। অফিসগুলোর টয়লেটের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। প্রায়ই দেখা যায় টয়লেট তো নোংরাই, সঙ্গে পানির ট্যাপটাও বিকল। অনবরত ট্যাপ থেকে ঝরছে পানির ধারা। মহামূল্যবান পানির অপচয় হচ্ছে। ঢাকা ওয়াসার এক লিটার পানি পানযোগ্য করতে কত টাকা খরচ হয়, সে হিসাব জানানো দরকার। এক লিটার পানির অপচয় মানে সেই পরিমাণ টাকা জলে ফেলে দেওয়া, অথচ এই ঢাকা শহরের অসংখ্য মানুষ এক কলস পানির জন্য সারা দিন বসে থাকে।
সম্পদের অভাবে অনেক দুঃখী মানুষের নি¤œ পর্যায়ের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায় না, অথচ অপচয়ের জন্য অর্থের অভাব হয় না। অর্থের অপচয় সব দেশেই কমবেশি হয়। তবে যেসব দেশে ধনীর সংখ্যা বেশি, সেখানে অপচয়ের শঙ্কা বেশি। আবার যেসব দেশে শিক্ষার হার কম, সচেতনতার হার কম, সেখানেও অপচয়ের শঙ্কা বেশি। বাংলাদেশে অপচয়ের পরিমাণ ও ব্যাপকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ অপচয় রোধ বা হ্রাস করার জন্য শুধু সরকারের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। সব সমস্যা সমাধানের ভার সরকারের ওপর দেওয়া যায় না। ছোটখাটো অভ্যাস আমাদের নিজেদেরই বদলাতে হবে। একটি পানির ট্যাপের দাম কত? বিদ্যুতের সুইচ অফ করতে কত সময়ের প্রয়োজন? পরিমিত খাবারের কথা কি সরকারকে বলতে হবে? স্বাস্থ্যই সুখের মূল। পরিমিত খাবার গ্রহণ সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। নাগরিক হিসেবে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব নিতে হবে। ছোটখাটো কিছু দায়িত্ব না নিলে তা আত্মপ্রতারণা হবে। বলা হয়ে থাকে, চীনে একসময় অপচয় ও দুর্নীতির ব্যাপক প্রচলন ছিল। কম্যুনিস্ট নেতা মা সে তুং এ অপচয় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। আজ চীন উন্নত। আমরা সচেতন হলে এমন দেশ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে একটি শিশুও অপুষ্টিতে ভুগবে না, একজন মানুষও অন্নজ্বালা নিয়ে নিদ্রাহীন যন্ত্রণাকাতর রাত যাপন করবে না।
ব্যাংকার
champookgmÑgmail.com