মো. মাসুম বিল্লাহ:সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। বাজেট প্রণয়ন ও সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রেও বিবেচনায় থাকে এ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। পরিকল্পনার মেয়াদ শেষে এটির কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে, তা নিয়ে পরিকল্পনার মেয়াদ শেষ হলে একটি মূল্যায়ন করা হয়। ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়া সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বিষয়েও এমন একটি মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। তাতে দেখা যাচ্ছে, সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের মধ্যে মোট দেশজ বিনিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, তা অর্জিত হয়নি। অথচ এর বিপরীতে প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, সেটি ঠিকই অর্জিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এমন মূল্যায়নের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সমাপ্তি মূল্যায়ন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ ভিত্তিবছরে দেশে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল দেশের মোট জিডিপির ২৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ। পরিকল্পনার শেষ বছর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট দেশজ বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল জিডিপির ৩২ দশমিক ৭০ শতাংশ। এর বিপরীতে অর্জন ৩১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ওই অর্থবছরে জিডিপিতে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাত দশমিক ছয় শতাংশ। কিন্তু সরকারের হিসাবে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে আট দশমিক ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তার চেয়েও বেশি অর্জন হয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগসহ সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য অধিকাংশ খাতেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।
বিশ্লেষকরা জানান, সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোর অর্জন একটি অপরটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অন্যান্য সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যতিরেকে কেবল জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে ফেলা সম্ভব নয়। সাধারণত এক শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য ন্যূনতম চার থেকে সাড়ে চার শতাংশ বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। কিন্তু সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে প্রবৃদ্ধির এ স্বাভাবিক নিয়ম অনুসৃত হয়নি। ওই সময় এক শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিপরীতে চার শতাংশের কম বিনিয়োগ পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর সপ্তম পরিকল্পনার শেষ বছর ২০১৯-২০ অর্থবছরে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাবে। ওই অর্থবছরে অর্থনীতির হিসাব মেলানোই কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক বিষয়েই অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল সে সময়।
সামষ্টিক অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধির এমন অসংগতির বিষয়টিকে সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির সঙ্গে তুলনা করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মাননীয় ফেলো ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ বিষয়ে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির অঙ্কটি অনেকটা সুতো ছেঁড়া
ঘুড়ির মতো। অর্থাৎ এই প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তার মূলের কোনো সংযোগ নেই। যেখানে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না, কর-জিডিপি অনুপাতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না, মোট জাতীয় সঞ্চয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে নাÑঅথচ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়ে যাচ্ছে। এ প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির বাস্তব চিত্রের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।’ প্রবৃদ্ধির বিষয়টি পর্যালোচনার সময় এসেছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন সময় এসেছে পুরো প্রবৃদ্ধির হিসাব নতুনভাবে পর্যালোচনা করার। এ কাজ সম্পন্ন করার জন্য একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ প্যানেলকে দায়িত্ব দিতে হবে, যাতে বিশেষজ্ঞরা প্রবৃদ্ধির হিসাবের ত্রুটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করার মাধ্যমে প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব বের করে আনতে পারেন।’
আবার বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা অর্জিত হয়নি। এর বিপরীতে সরকারি বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি বেসরকারি খাতনির্ভর হলেও বিনিয়োগ খরা কমাতে সরকারকে সরকারি বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২২ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ। এ বিনিয়োগ ২০১৯-২০ অর্থবছর নাগাদ ২৬ দশমিক ছয় শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা অর্জিত হয় ২২ দশমমিক শূন্য ছয় শতাংশ। এক্ষেত্রে কভিডের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আর এর আগের অর্থবছর ২৫ দশমিক এক শতাংশ বেসরকারি বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিনিয়োগ হয় ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। অন্যদিকে সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ ভিত্তিসময়ে এ বিনিয়োগ ছিল ছয় দশমিক ৮২ শতাংশ। পরিকল্পনার শেষ বছর ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাত দশমিক আট শতাংশ। অথচ এটি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় আট দশমিক ৪১ শতাংশ।
প্রবৃদ্ধির হিসাব যে কেবল জিডিপির বিপরীতে বিনিয়োগের হিসাবের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ তা নয়, সামষ্টিক অর্থনীতি অন্যান্য সূচকের ক্ষেত্রে সপ্তম পরিকল্পনায় যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, সেগুলোর অধিকাংশই অর্জিত হয়নি। রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশের প্রকৃত রপ্তানি আয় ছিল মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রপ্তানির লক্ষ্য ধরা হয় জিডিপির ১৫ দশমিক সাত শতাংশ। তবে ওই বছর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রপ্তানি আয় কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে জিডিপির ১৬ দশমিক ৬৫ শতাংশে উন্নীত হয়। এর পরের কোনো অর্থবছরেই রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। রপ্তানিতে সবচেয়ে বেশি ধস নামে ২০১৯-২০ অর্থবছরে। এক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী কভিড অতিমারি। ওই অর্থবছরে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল জিডিপির ১৬ দশমিক দুই শতাংশ। এর বিপরীতে অর্জিত হয় ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এর আগের অর্থবছর রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল জিডিপির ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এর বিপরীতে অর্জন হয় ১৫ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ দশমিক সাত শতাংশ। এর বিপরীতে অর্জন হয় ১৪ দশমিক আট শতাংশ।
কর-জিডিপি অনুপাতের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সপ্তম পরিকল্পনার কোনো বছরেই এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। পরিকল্পনার প্রথম বছর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপির বিপরীতে কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ছয় শতাংশ। এর বিপরীতে আহরণ হয় আট দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর পরের অর্থবছর সাড়ে ১১ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আহরণ হয় ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২ দশমিক তিন শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে কর আহরণ হয় মাত্র আট দশমিক ছয় শতাংশ। এর পরের অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ দশমিক এক শতাংশ। এর বিপরীতে আহরণ হয় আট দশমিক ৯ শতাংশ। আর সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪ দশমিক এক শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে কর আহরণ হয় ১১ দশমিক দুই শতাংশ।
এর বাইরে জাতীয় সঞ্চয়ের ক্ষেত্রেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের ক্ষেত্রেও। তবে মূল্যস্ফীতির যে প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল, তা সরকার অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।