কামরুল হাসান মামুন
[গতকালের পর]
নানা রকম বাধা পেরিয়ে যেসব মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যায়, তাদের বেশিরভাগই আর ফিরতে চায় না। কারণ দেশকে বসবাসের অযোগ্য করে রাখা হয়েছে। এত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়া হয়েছে, কিন্তু দেশের মানুষের মধ্যে ন্যূনতম ‘সিভিক সেন্স’ তৈরি হলো না। লেখাপড়া করেও আচরণে ও মানসিকতায় উন্নত হচ্ছে না আমাদের ছেলেমেয়েরা। সমাজের সব স্তরেই একই অবস্থা। পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা না করে যে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়, তা আমরা শিখলাম না। এদেশে উন্নয়ন মানে নদী ধ্বংস, বন উজাড় ও পাহাড় ধ্বংস। দেশের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই যারাই পারছে বিদেশে স্থায়ী হচ্ছে। আবার দেশে ফিরলেও তাদের অনেকেই শিক্ষকতা পেশায় আসতে চায় না। বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষক থাকা বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শৈশবেই মানসিকতার ভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত যোগ্য ছেলেমেয়েরা স্কুলশিক্ষক হতে চায় না। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা যা দেয়া হয়, তাতে তারা সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারেন না। বাধ্য হয়ে তাদের প্রাইভেট টিউশন বা কোচিংয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে ক্লাসে পাঠদানে যথেষ্ট মনোযোগ ও আগ্রহ পান না। আবার শিক্ষার্থীরাও এসব শিক্ষককে সম্মান করে না। কারণ অর্থের জন্য ক্লাসে না পড়িয়ে তারা কোচিংয়ে পড়াচ্ছেন। সেটাই স্বাভাবিক। এভাবে তারা ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের বঞ্চিত করছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই তারা উদ্যম ও কার্যক্ষমতার পুরোটা ক্লাসে দিতে পারছেন না। তাহলে যে শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে অন্যায় করতে দেখছে, তারা কীভাবে সৎ ও আদর্শবান হতে শিখবে? তাছাড়া একজন শিক্ষক শুধু ক্লাসরুমেই শিক্ষা দেন না। শিক্ষককে যথাসম্ভব ‘অ্যাভেইলেবল’ হতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়াসহ অন্যান্য প্রয়োজনে শিক্ষকের সাহায্য পেতে পারে। শিক্ষক অর্থ উপার্জনের পেছনে দৌড়াতে থাকলে শিক্ষার্থীদের সময় দেবেন কখন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবারে প্রথম সারির সেরা পাঁচ শিক্ষার্থীকে আমরা দেশে রাখতে পারি না। উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা দেশে থাকলে, বিশেষত তাদের শিক্ষকতা পেশায় রাখতে পারলে তারা একটা সুশিক্ষিত জেনারেশন তৈরি করতে পারত। সুশিক্ষা একটা চেইন রিঅ্যাকশনের মতো সামনের দিকে ছড়িয়ে যেত। রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে এর অনেক বড় প্রভাব দেখা যেত। সমস্ত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সমস্যার মূলে হলো আমাদের মানহীন শিক্ষা। সবাই লেখাপড়া শিখছে, কিন্তু কথায়, কাজে ও আচরণে তার কোনো প্রকাশ নেই। যেখানে-সেখানে থুথু বা ময়লা ফেলছে সবাই। প্রাথমিক স্কুলে ভালো বেতনে উচ্চশিক্ষিত ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিলে তারা দায়িত্ববোধ থেকে বাচ্চাদের এসবের গুরুত্ব শেখাতে পারত।
শিক্ষায় বরাদ্দ না বাড়িয়ে প্রতি বছরের শুরুতে ‘বিনা মূল্যে বই বিতরণ’ করাকে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। আমরা এখনও শিক্ষা নিয়ে এমন ধারণায় পড়ে আছি যে প্রাথমিক শিক্ষা বা সর্বজনীন শিক্ষায় বাচ্চাদের বিনা মূল্যে বই দেয়াকে বিরাট দান হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। সে বইয়ের বিষয়বস্তুর মান, প্রচ্ছদ, ছাপার ও কাগজের মান বিবেচনা করলে তাকে জাকাতের কাপড়ের সঙ্গে তুলনা করতে হয়। সবচেয়ে নিম্নমানের বই দেয়া হচ্ছে প্রাথমিক স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাদের। এটা দুঃখজনক। আর বইগুলো যারা লিখছেন ও সম্পাদনা করছেন, তারাও বইয়ের কনটেন্টের ব্যাপারে যথেষ্ট মনোযোগী নন।
অনেক শিক্ষকের আচরণ ও মানসিকতায়ও প্রকৃত শিক্ষার ছাপ পাওয়া যায় না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি পদে কাদের নিয়োগ দেয়া হয়, তা খেয়াল করলে বোঝা যায়, দলান্ধ ও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করা শিক্ষকরাই পুরস্কৃত হন এদেশে। অন্যান্য সেকটরের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও শ্রেণিবৈষম্য ও চাটুকরিতায় সয়লাব। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ক্যান্টিন, লাউঞ্জ ও ওয়াশরুম আলাদা, লিফটও আলাদাÑঠিক যেমন এদেশে বিরাট আলিশান ফ্ল্যাটেও পরিচারিকার জন্য সেলটি থাকে অতি ক্ষুদ্র, জানালাবিহীন। সে বাসার সোফায় বসতে পারবে না। খাবার টেবিলে সবার সঙ্গে বসে খেতে পারবে না। কেন? সে কি মানুষ নয়? তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণি এ ধরনের বর্বর চর্চা জিইয়ে রেখেছে। তাহলে আমরা কেমন শিক্ষিত হলাম? একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা এসব ক্ষুদ্রতা ও ছোটলোকি নিয়ে পড়ে আছি। সমাজের একেবারে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত একই চেহারা। একমাত্র সুশিক্ষাই পারে এই অন্ধকার দূর করতে।
শিক্ষা শুধু স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্জন করার বিষয় নয়। শাহ আবদুল করিম বা লালন শাহ প্রথাগত লেখাপড়া করেননি। কিন্তু তাদের সৃষ্টিকর্মে আমরা বুঝতে পারি তারা কত উদার ও উন্নত মানসিকতার মানুষ ছিলেন। এমনকি যাদের বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে, তাদের অনেকেই এসব মজ্জাগত হীনম্মন্যতা থেকে বের হতে পারে না। তাদের দেখে শেখার মতো পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাও নেই, নতুন জ্ঞানকে গ্রহণ করার মতো মনের উদারতাও নেই। তাদের শিক্ষা বৃথা। অর্থাৎ, শিক্ষার কাজ কেবল কিছু তথ্য মাথায় প্রবেশ করানো নয়। মানসম্মত শিক্ষা মনের ভেতরে উন্নত বোধের সঞ্চার করে, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ব্যক্তির কথায়, আচরণে ও কাজে।
শুধু তা-ই নয়, মানসম্মত শিক্ষা আমাদের মনে আরও জানার আগ্রহ তৈরি করে। আমরা দেখি, ছাত্রজীবনে যে ছেলেমেয়েরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে, তারা কর্মক্ষেত্রে গিয়ে সেই একই অন্যায় কাজগুলো করছে। একবার চাকরি পেয়ে গেলে তাদের জ্ঞানপিপাশা শেষ হয়ে যায়। ফলে বদ্ধ জলাশয়ের মতো তাদের মনেও ময়লা জমতে শুরু করে। শিক্ষকরাও একই কাজ করছেন। চাকরি পাওয়ার পর আরও লেখাপড়া ও গবেষণা করে নিজেকে উন্নত করার কোনো তাড়না তাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। কারণ কয়েক বছর পরপর প্রোমোশন তো হবেই। শিক্ষকতা তার কাছে স্রেফ একটা চাকরি।
রিচার্ড ফিলিপস্ ফাইনম্যান পৃথিবীর অন্যতম সেরা পদার্থবিদ ছিলেন। তিনি একেকটা ক্লাস নেওয়ার আগে ফাঁকা ক্লাসরুমে গিয়ে রিহার্সাল করতেন। বোস্টন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ইউজিন স্ট্যানলি কোরিয়াতে একটা সেমিনারে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তার বক্তব্য শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কীভাবে এত চমৎকার বক্তব্য দিতে পারেন?’ তার উত্তর ছিল, ‘আমি প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি জোকস্, এমনকি প্রতিটি বিরামকাল প্র্যাকটিস করেছি। এত মানুষ তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করে আমার কথা শুনতে এসেছে। এর চেয়ে কম কিছু তাদের দিতে পারি না।’ সুশিক্ষা এভাবেই মানুষেকে কাজের প্রতি সৎ ও দায়িত্বশীল করে।
মোটকথা, শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। গবেষণা ও উন্নয়ন খাত তৈরি করে উন্নয়নের ভবিষ্যৎ পথ খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের শিক্ষিত যুবসমাজকে দেশের কাজে লাগাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হতে হবে বিশ্বমানের। সেরা বেতনে সবচেয়ে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। তবেই সত্যিকারের উন্নয়ন হবে। [শেষ]
শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়