সামাজিক দায়বোধ থেকে হিজড়াদের স্বীকৃতি দিতে হবে

শামীমা চৌধুরী: রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আজ কাজের খুব চাপ। পরপর কয়েকটি মিটিং আছে। নিবিষ্ট মনে কাজ করছে কম্পিউটার অপারেটর মারুফ। দৌড়াদৌড়ির মধ্যে রয়েছে জনিও। বসদের রুমে চা দেয়া, টেবিল পরিষ্কার করা, ব্যাংকে যাওয়া-কত কাজ তার। তবে তাদের চলাফেরার ভেতরে মেয়েলি ছাপ বেশি। তাই সহকর্মীরা খানিকটা বাঁকা চোখে তাকায়। এতে তারা অসহায় বোধ করে। কিছুটা ভয়ে ভয়েও থাকে।

মাস্টার রোলে বা দৈনিক মজুরিভিত্তিতে কাজ করে তারা। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরে এই দু’জনকে যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে স্থায়ী পদে নিয়োগ দেয়া হবে। মারুফ সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা পাস করা। আর জনি হোসেন অষ্টম শ্রেণি পাস করেছে। তবুও মারুফ আর জনি হোসেন হিজড়া হিসেবেই পরিচিত। দুর্ভাগ্য তাদের, ‘হিজড়া’ পরিচয় এনে দিয়েছে।

সকলের অবহেলা আর উপেক্ষার পাত্র ছিল তারা। তাদের ভাগ্য আজ বদলে দিয়েছেন রাজশাহীর জেলা প্রশাসক মো. আবদুল জলিল। তার এই নিয়োগ সরকারি প্রতিষ্ঠানে হিজড়াদের অন্তর্ভুক্তির স্বীকৃতি। হিজড়া প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘পরিবার থেকে নির্বাসিত এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো পেটের দায়ে যৌনকর্মী বা ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন চালায়। অমানবিক জীবনযাপন করে। তারা অচ্ছুৎ, পৃথিবীতে যেন তাদের কেউ নেই। তৃতীয় লিঙ্গের বা বৃহন্নলা মানুষের শারীরিক গঠনে কিছুটা ব্যতিক্রম আছে কিন্তু অস্বাভাবিকতা নেই। তাদের দুরবস্থার কথা জানার পর আমি ডেকে এনে এখানে কাজ দিয়েছি। যোগ্যতানুযায়ী তারা কাজ পাবে। এই দৃষ্টান্ত আমি রেখে গেলাম।’

সমাজের এই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এখন বোঝে তারাও মানুষ। মারুফ আর জনি মনে করে, নাচ-গান আর ভিক্ষাবৃত্তি তাদের জন্য সম্মানজনক পেশা হতে পারে না। তারাও মানুষ। আর এ কারণে তারা পড়াশোনা করেছে। আগে মেয়েদের মতো পোশাক পরতো। এখন পরে না।

মানব সভ্যতার আদিকাল থেকেই হিজড়া সম্প্রদায় ছিল। হরমোনগত সমস্যার কারণে তাদের এ পরিবর্তন। না পুরুষ, না নারী, একসময় তাদের সংসার ছেড়ে চলে যেতে হয়। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। তবে বেসরকারি সূত্রমতে, এই সংখ্যা লাখের বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিজড়ারা জš§গ্রহণ করে পুরুষ হিসেবে। ধীরে ধীরে শারীরিক পরিবর্তন হয়ে তারা পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যায়। পরিচয় সংকটে ভোগে।

অনেকে যৌনাঙ্গ অপারেশন করিয়ে ফেলে। এদের ভেতর নারীর রূপটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। কেউ আবার নারী ও পুরুষ, উভয় রূপেই থাকে। তবে তারা নারী বা পুরুষ কোনোটিই নয়। বেশিরভাগ হিজড়া হিন্দু ধর্মের প্রতি অনুরাগী। পূজা-অর্চনা করলেও ধর্মীয় স্থানে এদের যাওয়াটা কেউ স্বাভাবিকভাবে নেয় না। তাই তারা নিজেদের ঘরেই পূজা-অর্চনা করে থাকে। এদের মধ্যে মুসলিম ও খ্রিষ্টানও আছে। আবার কেউ কেউ হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মই পালন করে। তবে হার খুবই কম। হিজড়ারা শহরের নির্দিষ্ট এলাকায় দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। তারা একা থাকতে চায় না। প্রত্যেক হিজড়ার রয়েছে একজন গুরু বা গুরু মা। ঘর থেকে বেরিয়ে হিজড়া জীবনের নিয়ম শৃঙ্খলা হিজড়ারা গুরুমার কাছ থেকে শেখে।  

পেছনে পড়া এ জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি পর্যায়ে রয়েছে অর্থ বরাদ্দসহ বেশ কিছু বিশেষ ব্যবস্থা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছর পাইলট কর্মসূচি হিসেবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, পটুয়াখালী, খুলনা, বগুড়া এবং সিলেটসহ ৭টি জেলায় এ কর্মসূচি চালু করা হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৭২ লাখ ১৭ হাজার টাকা। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে আরও ১৪টি জেলায় এই কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা হয়। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ২১টি জেলার জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৪ কোটি ৭ লাখ ৩১ হাজার ৬০০ টাকা। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে এ খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৭২ হাজার টাকা এবং ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে পরিমাণ বেড়ে ৮ কোটি টাকা। এভাবে প্রতি বছর বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ছে এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকায় পৌঁছায়। এছাড়া সরকারি পর্যায়ে হিজড়া জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আরও বেশ কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে স্কুলগামী তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৪ স্তরে উপবৃত্তি উল্লেখ করার মতো। এ কর্মসূচির আওতায় প্রাথমিক স্তরে জনপ্রতি মাসিক ৭০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে জনপ্রতি ৮০০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ১ হাজার টাকা এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জনপ্রতি মাসিক ১ হাজার ২০০ টাকা হারে উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। সরকার  অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের জন্য বিশেষ ভাতা চালু করেছে। ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের জনপ্রতি মাসিক ৬০০ টাকা হারে ভাতা দেয়া হচ্ছে। ৫০ দিনে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম হিজড়া জনগোষ্ঠীর দক্ষতাবৃদ্ধি ও আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ড সম্পৃক্ত করে তাদের সমাজের মূলসে াতধারায় আনার চেষ্টা চলছে। প্রশিক্ষণোত্তর আর্থিক সহায়তা হিসেবে প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। কড়া মেকআপ দিয়ে আর পোশাক সুন্দর পরে, অদ্ভুত সাজ পোশাক করে হিজড়ারা চলাফেরা করে। তাদের বেশিরভাগের হাতে থাকে ফোন। এদের পেশা বলতে বিশেষ ভঙ্গিতে হাততালি দিয়ে গণপরিবহন, রাস্তাঘাট, বাজার কিংবা বাসায় বাসায় ঘুরে ঘুরে টাকা পয়সা জোগাড় করা। এছাড়া নবজাতক পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ-গান করেও তারা পয়সা-উপার্জন করে থাকে। কেউ কেউ যৌনকর্মী হিসেবেও কাজ করে, যা সমাজের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

২০১৯ সালে স্বতন্ত্র লিঙ্গীয় পরিচয়ে হিজড়ারা ভোটাধিকার লাভ করে। এখন তারা তাদের পাসপোর্টে বা জাতীয় পরিচয়পত্রে লিঙ্গীয় পরিচয় হিসেবে হিজড়া উল্লেখ করতে পারে। রাষ্ট্রীয়ভাবে লিঙ্গীয় স্বীকৃতি লাভ করলেও এখনও তারা সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। অধিকাংশেরই জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস নেই। করোনার টিকা নেয়ার ব্যাপারে তারা বেশ পিছিয়ে।  রাজধানীর মান্ডা এলাকায় বসবাসকারী হিজড়া শ্রাবন্তী জানালেন, ‘একদিন মুগদা হাসপাতালে গিয়েছিলাম। নিবন্ধন অ্যাপে দেখা যায়, আমি একজন পুরুষ। আমি পুরুষ না, হিজড়া। কিন্তু অ্যাপে ওই অপশনটি নেই। আমরা করোনা টিকা নিতে চাই। কিন্তু আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। অনলাইনের নিবন্ধন আমরা বুঝি না।’

হিজড়া সংঘের সভাপতি ইভান আহমেদ বলেন, ‘টিকা নিবন্ধন অ্যাপে পুরুষ ও নারীর ঘর আছে। কিন্তু হিজড়াদের কোনো ঘর নেই। স্বীকৃতি না থাকলে আমরা কীভাবে টিকা নেব। অথচ হিজড়াদের ভেতর করোনা সংক্রমণ রয়েছে।’

প্রকৃতপক্ষে সরকার হিজড়াদের জন্য যে বরাদ্দ দিয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কীভাবে এটি জোগাড় করতে হয়, তাও তারা জানে না। ফলে রাস্তায় বা গণপরিবহনে ভিক্ষা না করে উপায় থাকে না তাদের। হিজড়ারা কারও ক্ষতি করে না। এরপরও তাদের দেখলে মানুষ ভয় পায়। কারও ঘরে প্রবেশাধিকার নেই তাদের। তাদের বাসস্থানে মানুষ ঢিল ছোড়ে। তারা যাবে কোথায়? তাদের মাঝে কেউ মারা গেলে গোপনে পুড়িয়ে ফেলতে হয় অথবা কবর দিতে হয়। জানাজানি হয়ে গেলে রক্ষা নেই।

আমাদের সমাজের তৃতীয় লিঙ্গের এ জনগোষ্ঠীর জন্য সহমর্মিতা, সহানুভূতি আরও বেশি করে চর্চা করা প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে এ জনগোষ্ঠীর মানুষ ইচ্ছে করে হিজড়া হয় না। তাদেরও বাবা-মা আছে। ভাইবোন আছে। তাদের পরিবারে ঠাঁই হয় না এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন সব থেকেও তাদের কিছুই নেই। সবকিছু থাকার পরও তাদের সমাজের অপাঙ্ক্তেয়। এ নির্মমতা কতকাল বয়ে নিয়ে যাবে আমাদের সমাজ। এ রক্তক্ষরণ বন্ধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক ও মানবিক দায়বোধ থেকে হিজড়াদের স্বীকৃতি দিতে হবে। 

পিআইডি নিবন্ধ