সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়িয়ে আসছে বাজেট

রহমত রহমান: আগামীকাল ঘোষিত হতে যাচ্ছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট। এটি সরকারের তৃতীয় মেয়াদের তৃতীয় এবং কভিডকালের দ্বিতীয় বাজেট। করোনাকালে বাজেট হওয়ায় এবার বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বেশি বরাদ্দ থাকছে বলে জানা গেছে।

নানা চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে করোনার মধ্যেও ব্যয় বাড়িয়ে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে সরকার। এর মধ্যে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকাই থাকবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। চলতি অর্থবছরের বরাদ্দের তুলনায় যা প্রায় দেড়গুণ। দেশীয় উৎস থেকে রাজস্ব আহরণ সংকুচিত হওয়ায় নতুন বাজেটে অর্থসংস্থানে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়বে। প্রথমবারের মতো বাজেটের ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে দেশের মোট জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। সাধারণত যা ৫ শতাংশের নিচে রাখা হয়। তবে কভিডকালে ২০২০-২১ অর্থবছরেও বাজেট ঘাটতি ৬ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছিল।

করোনায় সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে আঘাত লেগেছে। ব্যবসার সঙ্গে কমেছে রাজস্ব আহরণ। ফলে এবারের বাজেটে দেশীয় শিল্প সুরক্ষা থাকবে কর ও ভ্যাটে বড় ছাড়। এবারের বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা তেমন বাড়বে না। কিন্তু ছাড় দেয়া রাজস্ব পুষিয়ে নিতে কিছু কিছু খাতে কর বাড়ানো হবে। এছাড়া রাজস্ব ফাঁকি রোধে থাকবে বিশেষ নির্দেশনা। সব মিলিয়ে এবারের বাজেটে ব্যবসায়ীদের সুরক্ষায় থাকবে বিশাল করছাড়। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, চলতি অর্থবছর কালোটাকা বিনিয়োগের ‘বিশেষ সুবিধা’ দেয়া হয়। মূলত করোনাকালে পুঁজিবাজার ও অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এই বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়। প্রায় তিন শতাধিক ব্যক্তি এই সুবিধা নিয়ে ৪৩০ কোটি টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে। তবে আগামী প্রস্তাবিত বাজেটে কালোটাকা বিনিয়োগের বিশেষ সুবিধা থাকছে না। তবে আগের মতোই জরিমানা দিয়ে কালোটাকা বিনিয়োগের সুবিধা থাকছে। এছাড়া পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর সাড়ে ৩২ শতাংশ থেকে আড়াই শতাংশ কমিয়ে ৩০ শতাংশ,  তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ করা হচ্ছে। আর লেনদেনের ওপর আরোপিত অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি) কমছে আর সুকুক, করপোরেট এবং ট্রেজারি বন্ডের ওপরও কর হার কমানো হচ্ছে।

সূত্র আরও জানায়, করোনায় লকডাউনে শিল্প-কারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শপিংমল সব ব্যবসাই কমবেশি আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে। সেই ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় শিল্পের বিকাশে প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাটে বড় ধরনের ছাড় দেয়া হচ্ছে। দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। হোম অ্যাপ্লায়েন্স সামগ্রী উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে আগামী দুই বছরের জন্য ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে। ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সার, গ্রাইন্ডার, ইলেকট্রিক কেটলি, রাইস কুকার, মাল্টি কুকার ও প্রেসার কুকার দেশে উৎপাদন করলে উপকরণ-যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট দেয়া লাগবে না। এয়ারকন্ডিশন ও রেফ্রিজারেটর উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। কৃষি আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে কৃষিকাজে ব্যবহƒত যন্ত্রপাতি আমদানিতে আগাম কর প্রত্যাহার করা হচ্ছে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে সিগারেটে নকল-জাল ও পুনঃব্যবহƒত ব্যান্ডরোল ব্যবহার বা ব্যবহারে সহায়তা করলে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি ভ্যাট বিভাগে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আর্থিক বিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলত করে ভ্যাট আইন সংশোধন করা হচ্ছে।

সূত্রমতে, তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার শিল্পের বিকাশে প্রিন্টার, টোনার কার্টিজ, ইনকজেট কার্টিজ, কম্পিউটার প্রিন্টারের যন্ত্রাংশ, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, এআইও, ডেস্কটপ, নোটবুক, নেটপ্যাড, ট্যাব, সার্ভার, কিবোর্ড, মাউস, বারকোড ও কিউআর কোড স্ক্যানার, পিসিবিএ/মাদারবোর্ড, পাওয়ার ব্যাংক, রাউটার, নেটওয়ার্ক সুইচ, মডেম, নেটওয়ার্ক ডিভাইস/হাব, স্পিকার, সাউন্ড সিস্টেম, এয়ারফোন, হেডফোন, এসএসডি/পোর্টেবল এসএসডি, হার্ডডিস্ক ড্রাইভ, পেনড্রাইভ, মাইক্রো এসডি কার্ড, ফ্ল্যাশ মেমোরি কার্ড, সিসিটিভি, মনিটর, প্রজেক্টর, প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড, ই-রাইটিং প্যাড, ইউএসবি ক্যাবল, ডিজিটাল ঘড়ি, বিভিন্ন প্রকার লোডেড পিসিবি উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি এক হাজার ৬০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে যন্ত্রাংশ আমদানিতে আগাম কর দিতে হয়। আগামী বাজেটে সেটিও বাতিল করা হচ্ছে। এছাড়া পলিপ্রোপাইলিন স্ট্যাপল ফাইবার, মোবাইল ফোন এবং স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপারের কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। শর্তসাপেক্ষে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে প্রস্তুতকৃত যন্ত্রাংশ সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

সূত্রমতে, কৃষি আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে এ খাতে ব্যবহƒত যন্ত্রপাতি আমদানিতে আগাম কর প্রত্যাহার করা হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছেÑথ্রেসার মেশিন, পাওয়ার রিপার, পাওয়ার টিলার, অপারেটেড সিডার, কম্বাইন্ড হারভেস্টর, রোটারি টিলার, উইডার (নিড়ানি) ও উইনোয়ার (ঝাড়াইকল)। পাশাপাশি স্ক্র্যাপ ভেসেল, স্টিল শিল্পের ওয়েস্ট ও স্ক্র্যাপ, ফেরো অ্যালয়, স্পঞ্জ আয়রন, পিভিসি ও পেট রেজিন উৎপাদনে ব্যবহƒত ইথাইলিন গ্লাইকল, টেরেফথালিক অ্যাসিড, ইথাইলিন/প্রোপাইলিন আমদানি এবং উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাজুবাদাম আমদানিতে আগাম কর প্রত্যাহার হচ্ছে।

সূত্র আরও জানায়, আমদানি পর্যায়ে ভ্যাটের আগাম কর (এটি) হার কমানো হচ্ছে। ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা ও সরল সুদ দুটোতেই ছাড় দেয়া হচ্ছে। আগাম কর হার ৪ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ করা হচ্ছে। আর ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা ও সরল সুদ হার দুটোই বাণিজ্য সহায়ক করতে যৌক্তিক করা হচ্ছে। বর্তমানে ফাঁকি দেয়া ভ্যাটের দ্বিগুণ জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে। আগামী বাজেটে এটি কমিয়ে ভ্যাট ফাঁকির সমপরিমান জরিমানার বিধান করা হচ্ছে। এছাড়া সময়মতো ভ্যাট না দিলে ভ্যাট আইন অনুযায়ী মাসিক ২ শতাংশ হারে সরল সুদের বিধান রয়েছে। এটি বাজেটে এক শতাংশ করা হচ্ছে।

সূত্রমতে, করোনার মধ্যেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে নতুন করে করারোপ করা হচ্ছে না। ফলে দাম বাড়ার সম্ভাবনা নেই। চাল, ডাল, চিনি, লবণ, দেশে উৎপাদিত পেস্ট, পাউরুটি, সাবান, বোতলজাত পানি, ফলের জুস, মসলা ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্যের বাজেটে নতুন করে কর আরোপ না করায় দাম বাড়বে না। কর অব্যাহতি-রেয়াতি সুবিধা এবং আমদানি করা সমজাতীয় পণ্যে শুল্ক আরোপ করায় বিদেশি খেলনার দাম বাড়লেও কমবে দেশি খেলনার দাম। আমদানি করা পূর্ণাঙ্গ মোটরসাইকেলের চেয়ে দেশে সংযোজিত মোটরসাইকেল কম দামে পাওয়া যাবে। দেশে কম্পিউটারসহ কিছু পণ্যের উৎপাদন উৎসাহিত করতে সেসব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বেশি হারে শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, রপ্তানিকে উৎসাহ দিতে প্রস্তাবিত বাজেটে রপ্তানি খাতে সব ধরনের কর অপরিবর্তিত থাকছে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের চলতি অর্থবছরের মতো করপোরেট কর, রপ্তানি আয়ে উৎসে কর ও নগদ প্রণোদনায় উৎসে কর দিতে হবে। এছাড়া বাজেটে ইসলামি বন্ড ‘সুকুক’ সম্পর্কে জনসাধারণকে আকৃষ্ট করতে এর মুনাফায় কর অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে।

সূত্রমতে, করোনায় ব্যবসায়ীদের আরও স্বস্তি দিতে ন্যূনতম আয়কর হার কমানো হচ্ছে। ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা কমানো হচ্ছে। এটি দেড় কোটি টাকা থেকে কমিয়ে এক কোটি টাকা করা হচ্ছে। বর্তমানে সঞ্চয়পত্রসহ ৯ খাতে বিনিয়োগ এবং ১৩ খাতে দান করলে কর রেয়াত পাওয়া যায়। এছাড়া বাজেটে মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্রঋণ থেকে আয়কে করমুক্ত করা হচ্ছে। মাছ চাষে কর সুবিধার অপব্যবহার রোধে ৩০ লাখ টাকার বেশি আয়ে ১৫ শতাংশ হারে করারোপ করা হচ্ছে। বর্তমানে মাছ চাষের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে করমুক্ত সুবিধা রয়েছে। এর পরের ১০ লাখ টাকা আয়ের ওপর ৫ শতাংশ এবং তার বেশি আয়ের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ হারে কর প্রযোজ্য রয়েছে। বাজেটের নতুন প্রস্তাবনায় প্রথম দুটি সøাব অপরিবর্তিত রেখে তৃতীয় সøাবে কর হার বৃদ্ধি করা হচ্ছে।