সজল মাহামুদ: বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। শুধু অর্থনীতি নয়, বিভিন্ন সামাজিক সূচক যেমন শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, গড় আয়ু প্রভৃতি কর্মযজ্ঞে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। সাফল্যের এই ধারা অব্যাহত রাখতে দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধ করে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
দুর্নীতিকেই বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাস্তবতা হচ্ছে দুর্নীতি এমন অপরাধ; যা সব উন্নয়নকে ভঙ্গুর করে দেয়। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৬ নম্বর লক্ষ্যমাত্রাটির মূল বক্তব্য, টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরি করা, সবার জন্য ন্যায়বিচারের সুযোগ প্রদান করা এবং সর্বস্তরে কার্যকর জবাবদিহিমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এ থেকে অনুধাবন করা যায়, দুর্নীতি নির্মূল না করে কার্যকর জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব নয়। দুর্নীতিকে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ উন্নত, উন্নয়নশীল, অনুন্নত সব দেশেই দুর্নীতির প্রকোপ রয়েছে। তবে এর মাত্রাগত তারতম্য রয়েছে। দুর্নীতি গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সুফল থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে। এর মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, বাজার ব্যবস্থাপনার বিকৃতি ঘটে, সংঘটিত অপরাধ বৃদ্ধি পায়। উন্নয়নশীল দেশে দুর্নীতির প্রভাব আরও প্রকট হয়। দুর্নীতি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে ধীরে ধীরে পঙ্গু করে দেয়। সর্বগ্রাসী এই অপরাধ দমনে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন বিরামহীনভাবে বহুমাত্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কমিশন বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধান অনুসরণ করে দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশে সমন্বিতভাবে স্বীয় দায়িত্ব পালন করছে। কমিশন দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার আগেই তা প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত অসংখ্য প্রতিরোধমূলক অভিযান পরিচালনা করছে। এসব অভিযানের কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার আগেই তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। সরকারি সম্পদ উদ্ধার হয়েছে, হয়রানিমুক্তভাবে অসংখ্য নাগরিক তাদের কাক্সিক্ষত সেবা পেয়েছেন, সেবা প্রদানকারী দপ্তরগুলো সচেতন হয়েছে। আবার দুর্নীতির ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই অভিযোগের অনুসন্ধানে ব্যবস্থাও নেয়া হয়। অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তদন্ত করে তাদের আইনের হাতে সোপর্দ করা হয়। অর্থাৎ দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে প্রতিরোধ, অনুসন্ধান, তদন্ত ও প্রসিকিউশন সমগুরুত্বে নির্মোহভাবে পরিচালনা করা হয়ে থাকে। আবার গণশুনানির মতো কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা ও সেবাপ্রত্যাশী জনগণের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার ব্যবস্থা করছে কমিশন। এর মাধ্যমে একদিকে স্থানীয়ভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের যেমন জবাবদিহি করতে হচ্ছে, তেমনি নাগরিকরা তাদের অধিকার নিয়ে সচেতন হচ্ছেন। সার্বিকভাবে তৃণমূল পর্যায়ে দুর্নীতিবিরোধী গণসচেতনতা আরও বিকশিত হচ্ছে।
কমিশনের নিজস্ব আউটরিচ কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের নগর, মহানগর, জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নাগরিকদের নিয়ে গঠিত দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির মাধ্যমে সমাজে সততা ও নিষ্ঠাবোধ জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। শুধু পরিণত নাগরিকদের নিয়ে নয়, কমিশন তরুণ প্রজš§ বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়েও সাংবার্ষিক।
বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। দেশের গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। তরুণরাই জেগে উঠবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সন্তানই পিতাকে নিবৃত্ত করবে দুর্নীতির পঙ্কিলতা থেকে। এ প্রত্যাশায় তরুণদের নিয়ে কমিশন দীর্ঘমেয়াদি কর্মকৌশল নিয়ে কাজ করছে। তারপরও দুর্নীতির মাত্রা জনআকাক্সক্ষা অনুসারে হ্রাস পেয়েছে বলার সময় এখনও আসেনি। তবে দুর্নীতিবিরোধী গণসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে এটা হয়তো সত্য। আইন আমাকে স্পর্শ করবে না এ ধারণাও হয়তো ভেঙেছে। অপরাধীর নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবার মানসিকতাও বদলেছে। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে সীমিত সম্পদ নিয়ে দুর্নীতির মতো বহুমাত্রিক ফৌজদারি অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদকের পক্ষে দুরূহ। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে তীব্র প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আসবে এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, আমলাতন্ত্র, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবীসহ সবাই সমন্বিতভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে এলে দুর্নীতির কুৎসিত সংস্কৃতির অবসান ঘটাবে। শুদ্ধ মানুষের পরিশুদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ হবে। সাংবিধানিক অঙ্গীকারের বাস্তব রূপায়ণ ঘটবে-যেদিন রাষ্ট্র অনুপার্জিত আয় ভোগ করার সব পথ রুদ্ধ করবে। অন্ধকারের অমানিশা কেটে আলোয় উদ্ভাসিত হবে বাংলাদেশ।
কমিশনের মামলায় ২০১৫ সালে সাজার হার ছিল ৩৭ শতাংশ, ২০১৬ সালে সাজার হার ৫৪ শতাংশ, ২০১৭ সালে সাজার হার ৬৮ শতাংশ, ২০১৮ সালে সাজার হার ৬৩ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে সাজার হার ৬৩ শতাংশ। এ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৭ সাল থেকে কমিশনের দায়ের করা মামলায় সাজার হার বর্ধিত মাত্রায় স্থিতিশীল রয়েছে। বিগত ২ বছর সাজার হার একই রয়েছে। এটা কমিশনের ইতিবাচক অর্জন। ২০১৫ সালে যেখানে মামলায় সাজার হার ছিল মাত্র ৩৭ শতাংশ, সেখানে ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ধারাবাহিক মামলার সাজার হার হচ্ছে ৬০ শতাংশের ওপরে। কমিশন কর্তৃক দায়েরকৃত মানিলন্ডারিং মামলার বিচারিক আদালতে ২০১৮ ও ২০১৯ সাল যেসব রায় হয়েছে তার শতভাগ মামলার সাজা নিশ্চিত হয়েছে। কমিশন নিজস্ব প্রজা ও অভিজ্ঞতার আলোকেই মামলার তদন্ত ও প্রসিকিউশনে গুণগত পরিবর্তন আনার অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে মামলা-মোকদ্দমা, গ্রেপ্তার, শাস্তিসহ সকল প্রকার নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরও জনআকাক্সক্ষা অনুসারে দুর্নীতির মাত্রা কমেছে তা স্পষ্টভাবে বলা সমীচীন হবে না। মুষ্টিমেয় দুর্নিবার এই লোভী মানুষগুলোকে দুর্নীতি থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা রাখতে পারে সামাজিক শক্তি। সামাজিকভাবে দুর্নীতিপরায়ণদের প্রতি মানুষের তীব্র ঘৃণা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারে। মানুষের আত্মমর্যাদা উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। অনেকেই বলেন, শিক্ষার সৌন্দর্য হলো কোনটি সঠিক এবং কোনটি ভুল তা নির্ণয় করার সক্ষমতা অর্জন করা। দুর্নীতি দমন কমিশন মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিক্ষার প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি প্রতিরোধে নিরলসভাবে কাজ করছে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টগুলো যদি আমরা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে এর নির্যাস হচ্ছে তরুণদের টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত করা। দুর্নীতি দমন কমিশন তরুণ শিক্ষার্থীদের মননে নৈতিক মূল্যবোধ গ্রথিত করার ক্ষুদ্র প্রয়াস হিসেবে বহুমাত্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, পরিণত মানুষের চিন্তাচেতনা ও মানসিকতার পরিবর্তন করা অত্যন্ত জটিল। তবে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন অপরিহার্য। দুর্নীতি দমন কমিশন এ লক্ষ্যে নানাবিধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। যদিও এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে তরুণদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। তাদের মানসিকতায় নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ করার কৌশল গ্রহণ হয়েছে। এ কৌশলের অংশ হিসেবেই দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাদের নৈতিক মূল্যবোধ বিকাশে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে সাংবার্ষিক ভিত্তিতে বিতর্ক ও রচনা প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ এ ধরনের কর্মসূচির মাধ্যমে তরুণ শিক্ষার্থীদের মননে উত্তম চারিত্রিক গুণাবলি গ্রথিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ কর্মপ্রয়াসে সবার সমন্বিত অংশগ্রহণ জরুরি। এসব সৃজনশীল কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করা দুদকের অন্যতম উদ্দেশ্য। দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সুশাসন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং হয়রানিমুক্ত সরকারি পরিষেবা নিশ্চিত করতে কমিশন ২০১৭ সালে কমিশনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ২৫টি সরকারি প্রতিষ্ঠানভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করে। প্রাতিষ্ঠানিক টিম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, জনহয়রানির উৎস ও কারণগুলো চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে সুস্পষ্ট সুপারিশ প্রণয়ন করে থাকে। এ প্রাতিষ্ঠানিক টিমের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা, বিভিন্ন নথি পর্যালোচনা, ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান আইন ও বিধি-বিধান বিশ্লেষণ, সরেজমিনে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শন, গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি এবং কমিশনের গোয়েন্দা সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি পর্যালোচনা করে সুপারিশমালা প্রণয়ন করে থাকে। ২০১৯ সালে কমিশন কর্তৃক ০৮টি প্রাতিষ্ঠানিক টিমের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির অন্যতম প্রধান বাধা হচ্ছে দুর্নীতি। আমাদের অনেক অগ্রগতিই দুর্নীতির কারণে ধ্বংস হয়ে যায়। পৃথিবীর কোনো দেশই দুর্নীতিকে পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি, তবে দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে অনেক দেশ সফল হয়েছে।
পিআইডি নিবন্ধ