Print Date & Time : 13 August 2025 Wednesday 8:24 pm

সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সবাইকে কাজ করতে হবে

আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা : অর্থনীতিতে ভোক্তাই সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী, যারা প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। সে কারণে উন্নত দেশগুলোয় ভোক্তাদের ‘ক্রেতা সম্রাট’ বলা হয়। ভোক্তা হিসেবে পণ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানার অধিকার আমাদের রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের দেশের মানুষের অজ্ঞতা ও ভোক্তারা অসংগঠিত হওয়ার কারণে এবং প্রায়ই তাদের কথায় কেউ গুরুত্ব দেয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের পছন্দ এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অতি উন্নত বিজ্ঞাপনের অসত্য তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে। তখন আমরা বিজ্ঞাপনের চাতুর্যতায় হারিয়ে যাই।

কোনো পণ্য, খাদ্য বা সেবা অথবা প্রসাধনীর তথ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছানো এবং পরিচয় করিয়ে দেয়ার অনত্যম মাধ্যম হচ্ছে বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলা হয়, ‘প্রচারেই প্রসার’। কিন্তু সেসব পণ্যের বিজ্ঞাপন যদি হয় মিথ্যা বা চাতুর্যপূর্ণ তথ্যনির্ভর ও প্রতারণামূলক, তখন ক্রেতা বা ভোক্তারা প্রতারিত হয়ে থাকেন। প্রখ্যাত একটি প্রবাদ আছে ‘ক্রেতা সাবধান নীতি’। কিন্তু বিজ্ঞাপনদাতা সাবধান নীতি বা বিক্রেতা অথবা উৎপাদনকারী সাবধান নীতি আছে কি?

প্রতিদিনই পণ্যের প্রচারের নামে মিথ্যা বা চাতুর্যপূর্ণ তথ্যনির্ভর, বিভ্রান্ত ও প্রতারণামূলক বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে আসছে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম যেমনÑটেলিভিশন, বেতার, এফএম রেডিও, পত্রিকা, ডিজিটাল ব্যানার এবং বিলবোর্ড ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রচলিত আইনবিরোধী এসব মিথ্যা বা চাতুর্যপূর্ণ তথ্যনির্ভর, বিভ্রান্তি ও প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে নিরীহ মানুষ খাদ্য এবং পণ্য ক্রয় করে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যগত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের হার (ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, স্থুলতা ইত্যাদি) ক্রমেই বাড়ছে। জনসচেতনতার অভাব, অস্বাস্থ্যকর খাবারের আগ্রাসী ও প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন প্রচারণার কারণে আমরা এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছি। ফলে আমাদের অপচয় বৃদ্ধির সঙ্গে স্বাস্থ্যঝুঁকিও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অসংক্রামক রোগের অন্যতম কারণ, অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ। অস্বাস্থ্যকর খাবারের কারণে অসংক্রামক রোগের হার প্রতিদিনই বাড়ছে, সঙ্গে বেড়ে চলেছে চিকিৎসা ব্যয়ও। এসব অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা ব্যয় সারাজীবন ধরেই চালাতে হয়, রোগের চিকিৎসা ব্যয় আকাশচুম্বী এবং অধিকাংশ মানুষের সামর্থ্যরে বাইরে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। চিকিৎসার পরও রোগী সুস্থ হবে না, কিন্তু পরিবারটি চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে নিশ্চিত পথে বসে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশ অসংক্রামক রোগের কারণে হয়।

বিশেষ করে যখন ওই বিজ্ঞাপনগুলো বিভিন্ন সেলিব্রিটি, জনপ্রিয় খেলোয়াড়, নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা ইত্যাদি ব্যক্তিদের দ্বারা অভিনয় করে বা গান গেয়ে আকৃষ্ট করা হয়। যখন খাদ্যপণ্যের বিজ্ঞাপনে তারা অভিনয় করে, ওই বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে অমুক খাদ্য খেলে দ্রুত লম্বা হবে, অমুক পণ্য/খাদ্য খেলে মেধাশক্তি বৃদ্ধি পাবে, অমুক পণ্য/খাদ্য খেলে অনেক বেশি শক্তিশালী হওয়া যাবে, অমুক পণ্য খেলে নিজের ছায়া ধরতে পারবে ইত্যাদি। তখন ক্রেতা বা ভোক্তা অনেক বেশি আকৃষ্ট হয়ে থাকে। এমন পণ্যগুলো ক্রয় করে অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি ক্রেতা ও ভোক্তারা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন।

সাবান, শ্যাম্পুসহ বিভিন্ন প্রসাধনী পণ্যের আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। শ্যাম্পু ব্যবহার করলে চুল অনেক লম্বা ও সিলকি হবে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ওই শ্যাম্পু ব্যবহার করে তরুণ বয়সে মাথার চুল সাদা হয়ে যাচ্ছে, অনেকেই মাথার চুল হারিয়ে মানসিকভাবে হীনম্মন্যতায় ভুগছেন। তরুণ বয়সে চুল হারানোর ফলে অনেকের বিবাহও ভেঙে যাচ্ছে। এছাড়া বিজ্ঞাপনে শিশু-কিশোররা বোতলজাত, প্যাকেটজাত, প্রক্রিয়াজাত অস্বাস্থ্যকর খাদ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অল্প বয়সে মুটিয়ে যাচ্ছে। ফলে শিশুরা অনেক অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণশক্তি, জীবনীশক্তি হারাচ্ছে।

কোম্পানিগুলো জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে, বিভ্রান্তিকর ও প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাধারণ নিরীহ মানুষকে প্রলুব্ধ করে চলছে। রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের কি কোনো প্রকার দায়িত্ব নেই! রাষ্ট্র শুধু জিডিপিকেন্দ্রিক রাজস্বের কথা ভাবে কিন্তু জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ানোর বিষয়টি চিন্তা করে না। জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির জন্য করপোরেট ক্রিমিনাল রেসপনসিবিলিটির আওতায় আনার কথা কেন ভাবছে না। জনস্বাস্থ্যের ক্ষতির জন্য করপোরেশনগুলোকে রেসপনসিবিলিটির আওতায় আনা রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে উল্লেখ আছে। শুধু প্রয়োগের ঘাটতি রয়েছে।

বিজ্ঞাপনে মিথ্যাচার কিংবা অসত্য তথ্য দিয়ে ভোক্তার আকৃষ্ট করতে তারকা, সেলিব্রিটি ও খেলোয়াড় ইত্যাদিকে ব্যবহার করছে কোম্পানিগুলো। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্যের প্রচার ও প্রসারে অংশ নেয়ার কারণে বহু তারকা সমালোচিত হয়েছেন। আইনে নিষিদ্ধ হওয়ার কারণেই এখন আর কেউ বিড়ি, সিগারেট ও তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপনে অংশ নেন না কিংবা শুভেচ্ছাদূত হন না।

প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি থাকলেও বিজ্ঞাপন মনিটরিং ও কোম্পানি ক্রিমিনাল রেসপনসিবিলিটি আইন না থাকার কারণে তারকা-সেলিব্রিটি-খেলোয়াড় ইত্যাদির সাহায্যে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিগুলো। বিজ্ঞাপনে যারা অভিনয় করছেন তাদেরও আইনগত কোনো প্রকার দায় দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের আইনে বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ ও পণ্য বা সেবা অনুমোদন অথবা সুপারিশের জন্য তারকাদের ব্যক্তিগত দায় সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা নেই। সম্ভবত এ কারণেই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কোম্পানি বর্ণিত গুণাগুণের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই ছাড়াই তারকারা অর্থের লোভে নিজেদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে জনস্বাস্থ্যের মারাত্মকভাবে ক্ষতি করছে এবং ভঙ্গ করছে রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন সেটি খেয়াল করেন না। সেগুলোর প্রতিনিধিত্ব করাও এক ধরনের প্ররোচনা বলা যায়। এ ধরনের কার্যক্রম শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যা দণ্ডবিধি ১৮৬০-এ উল্লেখ আছে।

স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য হুমকি এমন পণ্য হতে রক্ষা এবং ভোক্তাদের সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ পাস করা হয়েছে। আশা করা হয়েছিল, আইনটি ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণে প্রভৃতি ভূমিকা রাখবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরিস্থিতি এখনও গ্রাহক অনুকূল হয়ে ওঠেনি। ভোক্তা অধিকার বিষয়ে আমাদের সচেতনতা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পেলেও তা এখনও যথেষ্ট নয়। তাই আমাদের  জ্ঞাত বা অজ্ঞাতে বিভিন্নভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। ওই আইনের ধারা-৪৪ বর্ণিত আছে, কোনো ব্যক্তি কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ; ধারা-৫৩ বর্ণিত হয়েছে, কোনো সেবা প্রদানকারী অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা অসতর্কতা দ্বারা সেবাগ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য বা জীবনহানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ নামে একটি আইন মহান সংসদে পাস করেন। উক্ত আইনে কোনো ব্যক্তি কোনো খাদ্যদ্রব্য বা খাদ্যোপকরণ বিপণন বা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে, বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্তিকর বা অসত্য তথ্য প্রদান করিয়া অথবা মিথ্যা নির্ভরতামূলক বক্তব্য প্রদান করে ক্রেতার ক্ষতিসাধন নিষিদ্ধ করা হয়েছে; এবং গুণ, প্রকৃতি, মান, ইত্যাদি সম্পর্কে জনগণ বিভ্রান্ত হইতে পারে, এমন অসত্য বর্ণনা সংবলিত কোনো বিজ্ঞাপন প্রস্তুত, মুদ্রণ, প্রকাশ বা প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উক্ত সব আইন থাকার ফলেও প্রতিনিয়ত পণ্যের প্রচারের নামে বিভ্রান্ত ও প্রতারণামূলক বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন গণমাধ্যমে দিয়ে আসছে। এগুলো দেখার বা মনিটরিং করার মনে হয় কেউই নেই।

এ ছাড়াও দণ্ডবিধি, ১৮৬০ স্বাস্থ্যহানিকর খাদ্য বা পানীয় বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আইনের ধারা-২৭৩ বর্ণিত আছে, যদি কোনো লোক এমন কোনো দ্রব্য, খাদ্য বা পানীয় হিসেবে বিক্রয় করে, প্রদান করে বা বিক্রয়ার্থে উপস্থাপন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর বিধান অনুসারে কোম্পানি ও বিজ্ঞাপনে মডেলদের কমন ইনটেনশন ও কমন অবজেক্টের জন্য বিজ্ঞাপনের মডেল ও সেলিব্রিটিদের দায়বদ্ধতার আওতায় আনার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

সাধারণভাবে বেশিরভাগ ভোক্তা অজ্ঞতার কারণে যে পণ্য ক্রয় করছেন তা কতখানি নিরাপদ, মানসম্পন্ন এবং যে খাদ্য খাচ্ছে তা কতখানি পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত জানে না। আমাদের দেশে সামাজিক ন্যায়বিচার এখনও সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই ভোক্তারা বাজারে প্রতিনিয়ত প্রতারিত ও প্রবঞ্চিত হন। দেশে সুসংগঠিত ভোক্তা আন্দোলন গড়ে না উঠায় এই প্রতারণা-প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না। ভোক্তাদের নীরবতা ও নির্লিপ্ততার এবং প্রচলিত আইনের যথোপযুক্ত প্রয়োগ না থাকার কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ও পণ্যের মিথ্যা বা চাতুর্যপূর্ণ তথ্যনির্ভর ও প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনগণের পকেট কেটে টাকার পাহাড় গড়ছে। তাই অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে অস্বাস্থ্যকর খাদ্য ও অনিয়ন্ত্রিত আগ্রাসনী, মিথ্যা বা চাতুর্যপূর্ণ তথ্যনির্ভর প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধে সরকারের উপরিউক্ত আইনের বাস্তবায়ন ও প্রণয়ন জরুরি।  সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়

সবাই কাজ করলে উৎপাদক, পরিবেশক যেমন কোনো প্রতারণা করবে না, ভোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

আইনজীবী

masumbillahlaw06@gmail.com