Print Date & Time : 5 August 2025 Tuesday 2:05 pm

সামুদ্রিক শৈবাল: সুনীল অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা

স্থল, নৌ ও জলভাগের বাইরে সমুদ্রসীমার প্রায় এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারজুড়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অধিকার। বিস্তৃত এই জলসীমায় রয়েছে সুনীল অর্থনীতির অপার সম্ভাবনা। আর এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে সমুদ্রের ভেতরে যেসব প্রাণিজ ও খনিজ সম্পদ রয়েছে, সেসবের আহরণ ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সমুদ্রে বিদ্যমান অঢেল সম্পদের মধ্যে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা একটি উল্লেখযোগ্য সম্পদ হচ্ছে সামুদ্রিক শৈবাল। বিশাল জলরাশির মাঝে লুকিয়ে থাকা সব সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেকাংশে বাড়িয়ে তোলা সম্ভব। তাই সমৃদ্ধি ও আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে ব্লু ইকোনমির সুনীল বিপ্লবের মাধ্যমে সামুদ্রিক শৈবালের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।

বর্তমান বিশ্বে শৈবাল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মহামূল্যবান সামুদ্রিক সম্পদ, যা আমাদের সমুদ্র অর্থনীতির এক সম্ভাবনাময় খাত। আমাদের দেশে খাবার হিসেবে জনপ্রিয়তা না থাকলেও বিশ্বজুড়ে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। সারাবিশ্বে সামুদ্রিক খাদ্যের ব্যবহার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুষ্টিগুণের বিচারে খাদ্য তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও ডেইরি, ওষুধ, টেক্সটাইল, কাগজশিল্প কিংবা জেলজাতীয় খাদ্য তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহƒত হয় সামুদ্রিক শৈবাল। এছাড়া সি উইড দিয়ে খাদ্য হিসেবে নুডলস জাতীয় খাবার, শরবত, সবজি, সলটেজ, ক্রিমচিজ, সমুচা, বিস্কুট, পোলট্রি ফিড, অ্যাগার অ্যাগার, আইসক্রিম তৈরির উপাদান, ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট প্রভৃতি প্রস্তুত করা সম্ভব। সামুদ্রিক শৈবালে খনিজ ও বায়ো-অ্যাক্টিভ উপাদান থাকায় দিন দিন এর গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া সামুদ্রিক শৈবালের কয়েকটি বিশেষ প্রজাতি থেকে গাড়ি ও বিদ্যুতের জ্বালানি হিসেবে বায়োফুয়েল, বায়ো-ইথানল, বায়ো-হাইড্রোকার্বন, বায়ো-হাইড্রোজেন ও বায়োগ্যাস প্রস্তুত করা সম্ভব। এমনকি সাবান, টুথপেস্টসহ বিভিন্ন প্রসাধনী তৈরিতেও সামুদ্রিক শৈবাল ব্যবহার করা যায়।

সম্প্রতি রাশিয়ার একদল বিজ্ঞানীর গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, সামুদ্রিক শৈবাল বায়ুমণ্ডলে থাকা গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনতে সক্ষম। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মাধ্যমে শৈবাল কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ ও অক্সিজেন ত্যাগ করে। শৈবালের উৎপাদন বৃদ্ধি বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তা করে। এছাড়া নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী সামুদ্রিক শৈবাল বিভিন্ন রাসায়নিক সারের অসাধারণ বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ হয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপ প্রায় শত কিলোমিটার। এখানে রয়েছে সামুদ্রিক শৈবালের প্রাকৃতিক বসতি। শৈবাল চাষের মাধ্যমে মাত্র এক হাজার ২০০ টাকা ব্যয় করে ছয় মাসে ১২ থেকে ১৮ হাজার আয় করা সম্ভব, যা বদলে দিতে পারে সমুদ্র উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর ভাগ্য।

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে সামুদ্রিক শৈবাল। কিন্তু এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে অনেকটাই ব্যর্থ বাংলাদেশ। ফলে যখন এশিয়ার অন্যান্য দেশ ৮৫ শতাংশ শৈবাল উৎপাদন থেকে অর্থোপার্জন করে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ এখনও শৈবালবিষয়ক প্রাথমিক গবেষণায় নিয়োজিত। কিন্তু এই অবস্থার উত্তরণ জরুরি। তাই স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে আধুনিক চাষ ব্যবস্থাপনা ও রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টিতে স্থানীয়দের শৈবাল চাষের প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি শৈবালের চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি করা জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনবল, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা, গবেষণা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, বিদেশি দক্ষ কোম্পানির সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এছাড়া শৈবালকেন্দ্রিক বিভিন্ন শিল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে বেকার লোকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। সর্বোপরি যথাযথ সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি ও বাজার সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করলে পোশাকশিল্পের চেয়েও সামুদ্রিক শৈবাল রপ্তানি করে বেশি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

রেহেনুমা সেহেলী কবির

শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়