সারা দেশে ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার সাড়ে ২৬ হাজার

 

ইসমাইল আলী: উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুৎ গ্রাহক। নতুন সংযোগও দেওয়া হচ্ছে নিয়মিতভাবেই। তবে সঞ্চালন ও বিতরণ সক্ষমতা সে অনুপাতে বাড়েনি। ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ায় ওভারলোডেড হয়ে পড়ছে বিভিন্ন কোম্পানি ও সংস্থার ট্রান্সফরমার। নিয়মিতই পুড়ছে এসব ট্রান্সফরমার। এতে সরকারের অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি গ্রাহক ভোগান্তি বাড়ছে।

ট্রান্সফরমারের ওভারলোড নিয়ন্ত্রণে আনা ও পুড়ে যাওয়া রোধে ২০১৪ সালে নীতিমালা করে বিদ্যুৎ বিভাগ। এর আওতায় বেশ কিছু নির্দেশনা জারি করা হয়। তবে পরিস্থিতির খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। গরমের পাশাপাশি শীতেও ট্রান্সফরমার পুড়ে যাওয়ার হার খুব বেশি কমেনি।

তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ২৬ হাজার ৫০৬টি ট্রান্সফরমার ওভারলোডেড অবস্থায় আছে। এগুলোর বিদ্যুৎ সরবরাহ ক্ষমতা প্রায় আট লাখ ৬৭ হাজার কিলো ভোল্ট। এর মধ্যে শুধু অক্টোবরেই পুড়েছে চার হাজার দুটি। এতে প্রায় ৪৮ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের সর্বশেষ মাসিক সমন্বয় সভায় এ তথ্য উঠে আসে।

ওভারলোডেড ও পুড়ে যাওয়া ট্রান্সফরমারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (পবিবো)। এজন্য সংস্থাটির বিভিন্ন সমিতির আওতায় নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। এরপরে রয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি)।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অনেক এলাকায় সক্ষমতার বেশি সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে হঠাৎ কোনো কোনো এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। এ বাড়তি চাহিদা তৈরি হওয়াকেই ওভারলোড বলা হয়। এ সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে না দিলে বিতরণ ব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দেয়। পুড়ে যায় ট্রান্সফরমারও।

পবিবো সূত্র জানায়, বর্তমানে সংস্থাটির ২৫ হাজার ১৫২টি ট্রান্সফরমার ওভারলোডেড। এসব ট্রান্সফরমারের সরবরাহ সক্ষমতা ছয় লাখ সাত হাজার কিলো ভোল্টের বেশি। ওভারলোডেড ট্রান্সফরমারের কারণে বেশ কিছু সমিতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়া অক্টোবরে সংস্থাটির তিন হাজার ৯১০টি ট্রান্সফরমার পুড়ে গেছে।

পিডিবির ওভারলোডেড ট্রান্সফরমারের সংখ্যা ৮৭৮টি। এগুলোর সরবরাহ সক্ষমতা এক লাখ ৬৫ হাজার কিলো ভোল্ট। এর মধ্যে অক্টোবরে সংস্থাটির ১৭টি ট্রান্সফরমার পুড়ে গেছে। আর ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার ৮২টি। এর মধ্যে অক্টোবরে পুড়ে গেছে ১৮টি।

ঢাকার একাংশে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ডিপিডিসির ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার রয়েছে ৩৮৬টি। এর মধ্যে অক্টোবরে পুড়ে গেছে ৫৭টি। আর সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। রাজধানীর অপর অংশে বিদ্যুৎ বিতরণকারী এ কোম্পানির ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার মাত্র আটটি। যদিও অক্টোবরে কোম্পানিটির ট্রান্সফরমার পুড়ে গেছে তার চেয়ে বেশি, ১৮টি।

বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মনোয়ার ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার কমিয়ে আনতে নিয়মিত সব সংস্থার কার্যক্রম মনিটরিং করা হচ্ছে। এছাড়া ট্রান্সফরমার পুড়ে যাওয়ার দায়-দায়িত্ব নিরূপণে সব সংস্থাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ-সংক্রান্ত অগ্রগতি প্রতি মাসে মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে বলা হয়েছে। এতে দুই বছরে সমস্যা অনেকখানি কমিয়ে আনা গেছে। ভবিষ্যতে ওভারলোডেড ট্রান্সফরমার আরও কমে আসবে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৯ সাল থেকে সরকার ৭৪টি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে। দেশে এখন ১০১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। এসব কেন্দ্রের সর্বোচ্চ উৎপাদনক্ষমতা ১২ হাজার ৩৩৯ মেগাওয়াট। ২০০৯-এর আগে যা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। অথচ সে অনুপাতে সঞ্চালন ও বিতরণ সক্ষমতা বাড়েনি। ২০০৯ সালে সঞ্চালন লাইন ছিল আট হাজার সার্কিট কিলোমিটার। এখন যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৭৮৯ সার্কিট কিলোমিটার। আর বিতরণ লাইন দুই লাখ ৬০ হাজার ৩০০ কিলোমিটার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৭২ হাজার কিলোমিটার।

নতুন সঞ্চালন লাইন তুলনামূলক কম বাড়লেও বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ২০০৯ সালে দেশের ৪৭ শতাংশ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় থাকলেও এখন তা দাঁড়িয়েছে ৬৩ শতাংশ। এতে সামগ্রিক বিদ্যুতের লোড বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ওভারলোডেড সমস্যা বাড়ছে।

এদিকে ওভারলোডের পাশাপাশি নিম্নমানের ট্রান্সফরমার ব্যবহারকেও পুড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিদ্যুৎ খাতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল’র সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, আগে কোরিয়া-জাপান থেকে উন্নত মানের ট্রান্সফরমার কেনা হতো। এখন ভারত ও চীন থেকে সস্তায় এগুলো কেনা হচ্ছে। এছাড়া নির্বিচারে সংযোগ দিয়ে ওভারলোড সমস্যা বাড়ানো হয়েছে। এসবের খেসারত হিসেবে এখন বছরে শতকোটি টাকার ট্রান্সফরমার পুড়ে যাচ্ছে।