রেজাউল করিম খোকন : ক্রমপরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে শিল্পের ভূমিকার বিষয়টিকেও নজর রাখতে হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় পরিবেশ ও জলবায়ুর বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক সম্পদের অপরিকল্পিত ব্যবহার বাড়ছে। পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ু, বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। শঙ্কা তৈরি হচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের। আগামী প্রজšে§র জন্য জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বর্জ্য ও দূষণ রোধ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সার্কুলার ইকোনমি বা বৃত্তাকার অর্থনীতির বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। পণ্য ব্যবহারের পর বর্জ্য সংরক্ষণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এর ফলে কার্বন নিঃসরণ কমে, দূষণের হাত থেকে রক্ষা পায় পরিবেশ। বৃত্তাকার অর্থনৈতিক মডেলে উৎপাদন ও ভোগের মধ্য সমন্বয় সাধন হয়। পণ্য ব্যবহারের পর বর্জ্য সংরক্ষণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এর ফলে কার্বন নিঃসরণ কমে, দূষণের হাত থেকে রক্ষা পায় পরিবেশ। তাই টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের কার্যকর হাতিয়ার হচ্ছে সাকুর্লার ইকোনমি। বিশ্বে এখন কেউ বর্জ্যকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে না। এক শিল্পের বর্জ্য অন্য শিল্পের জন্য উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন, ২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশের। এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আর সেজন্য সার্কুলার ইকোনমির বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। যে হারে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার হচ্ছে, তাতে কয়েক বছরের মধ্যে মূল্যবান বিভিন্ন খনিজের মজুত শেষ হয়ে যাবে। তবে পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে এ বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব। ওই বিবেচনা থেকেই এখন বৃত্তাকার অর্থনীতির দিকে এগোনো দরকার।
দেশে নির্মাণশিল্প, টেক্সটাইল, মোটরগাড়ি, লজিস্টিকস, কৃষি, আসবাব, তেল ও গ্যাস এবং নবায়ণযোগ্য জ্বালানি খাতকে সার্কুলার ইকোনমিতে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু বার্ষিক প্লাস্টিক ব্যবহার মাত্র সাত থেকে আট কেজি। পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে প্লাস্টিক-বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর করছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রে এ পরিমাণ ১৩০ কেজি। পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্যকে আবার সম্পদে রূপান্তর করছে দেশটি। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো সার্কুলার ইকোনমি প্রয়োগের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। ইউরোপীয় কমিশন এরই মধ্যে সার্কুলার ইকোনমি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছে। এছাড়াও চীন, ব্রাজিল, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান তাদের অর্থনীতিকে সার্কুলার ইকোনমিতে রূপান্তরের জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশেরও একই উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তবে সেজন্য বর্জ্যকে ধরন অনুযায়ী আলাদা করে সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে আলাদা কোনো ডাম্পিং জোন নেই, যেখানে বর্জ্যকে আলাদা করা সম্ভব। এজন্য সমন্বিতভাবে মন্ত্রণালয়গুলোর কাজ করা জরুরি। সার্কুলার ইকোনমি নিয়ে কাজ করতে মন্ত্রণালয়ে একটি আলাদা সেল গঠন করতে হবে। এই সেল সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংগঠনের সঙ্গে একত্রে কাজ করবে। সার্কুলার ইকোনমি বিকাশের জন্য অপরিহার্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। দেশে অনানুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। এ খাতের আনুষ্ঠানিকভাবে শিল্পের মর্যাদা পাওয়া উচিত। এ বিষয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। তারপরও বৃত্তাকার অর্থনীতি নিয়ে কাজ করতে মন্ত্রণালয়ে একটি আলাদা সেল গঠন করা হবে। এই সেল সরকারি-বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে কাজ করবে। বর্তমানে ৪০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। বাকি ৬০ শতাংশকেও এর আওতায় আনতে হবে। এজন্য প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ওয়ার্কিং পেপার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। যে হারে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার হচ্ছে, তাতে কয়েক বছরের মধ্যে মূল্যবান বিভিন্ন খনিজের মজুত শেষ হয়ে যাবে। তবে পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে এ বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশের বৃত্তাকার অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা আছে। দেশে অনানুষ্ঠানিক খাতে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হয় এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতা বাড়ছে। এই খাতকে শিল্প হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলে দেশের সার্কুলার ইকোনমির বিকাশ আরও গতিশীল হবে।
গত ১০ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি খুবই প্রশংসনীয়। শিল্পায়ননির্ভর অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিগত চার দশকে একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পেছনে আমাদের যে যাত্রা তার মূলে রয়েছে শিল্পের অভাবনীয় বিকাশ, কিন্তু পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধির দিকে যাব কি না, এখন তা নির্ধারণ করার সময় এসেছে। কেননা সম্পদের অবক্ষয় শুধু আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কিংবা প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, বরং ভবিষ্যতকেও চরম ঝুঁকিতে ফেলবে। টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়, সরকারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতা ও সচেতনতা বাড়াতে আরও বিনিয়োগ করা জরুরি। সম্পদে পরিণত করতে বিশ্বে এখন এক শিল্পের বর্জ্য আরেক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে। এমনকি কোনো পণ্য ব্যবহারের পরও তা ব্যবহƒত হচ্ছে অন্য পণ্য তৈরির উপকরণ হিসেবে। এ প্রক্রিয়া সার্কুলার ইকোনমি বা বৃত্তাকার অর্থনীতি হিসেবে পরিচিত। টেকসই অর্থনীতির জন্য বাংলাদেশকেও বৃত্তাকার অর্থনীতির পথে যেতে হবে। সার্কুলার ইকোনমির সঠিক বাস্তবায়নে চাহিদা ও জোগানের সমন্বয়ের জন্য অ্যাকাডেমিয়া, শিল্প খাত ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করা প্রয়োজন। আমাদের শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে। বিশেষ করে আমাদের গার্মেন্টশিল্প নানা সংস্কার, পরিবর্তন এবং রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক বাধা, বিপত্তি প্রতিকূলতা, ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে আমাদের গার্মেন্ট খাতকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এখন পরিবেশ সুরক্ষার দিকে সবাইকে আলাদা মনোযোগ দিতে হচ্ছে। গার্মেন্ট সামগ্রী ক্রেতা দেশ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, গোষ্ঠী এখন গার্মেন্ট উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবেশবান্ধব, শ্রমিকবান্ধব নানা শর্ত আরোপ করছেন, যেসব শর্ত পূরণের মাধ্যমেই কেবল তাদের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। আর এজন্য এখন গার্মেন্টশিল্পে কমপ্লায়েন্সকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। অতীতে এ বিষয়টিকে এক প্রকার অগ্রাহ্য করা হয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোয় প্রতিবছর সুতা ও কাপড় ডাইং ও ওয়াশিংয়ে এক হাজার ৫০০ কোটি লিটার পানি খরচ হয়। বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, এত বিপুল পরিমাণ পানি দিয়ে ছয় লাখ অলিম্পিক সুইমিং পুল পূর্ণ রাখা সম্ভব। সমপরিমাণ পানি এক বছরে আট হাজার লোকের চাহিদা পূরণ করতে পারে। প্রতিটি জিন্স প্যান্ট যার ওজন প্রায় এক কিলোগ্রাম, এমন একটি প্যান্ট ওয়াশিংয়ে ২৫০ লিটার পানি ব্যবহƒত হয়। এই পানি কোনো কেমিক্যাল নয়, স্রেফ সাধারণ পানি, যা ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে উত্তোলন করে ব্যবহƒত হচ্ছে। ভয়াবহ মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার এভাবেই বাড়ছে দিনে দিনে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে। সাধারণত ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে যখন এত বিপুল পরিমাণের পানি তোলা হয়, তখন সেখানে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এভাবে যত শূন্যতার সৃষ্টি হবে, তত ভূমি নিচের দিকে দেবে যাওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হবে। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বেশিরভাগ এলাকার পানির স্তর সুবিধাজনক এবং নিরাপদ অবস্থানে নেই। ফলে যে কোনো ধরনের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
পরিবেশের ওপর শিল্পের আরেকটি ক্ষতিকর প্রভাব হলো, কারখানার ব্যবহƒত পানি নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওর-বাঁওড়ে প্রাবাহিত হয়ে যায়। পোশাক কারখানার এই বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ও রংমিশ্রিত পানি নদ-নদী ও খাল-বিলের পানিকে মারাত্মকভাবে দুষিত করছে, যার ফলে নদ-নদী ও খাল-বিলের মাছ মারা যাচ্ছে, চাষাবাদে বিঘœ ঘটছে। এতে কৃষি উৎপাদনে প্রতিকূল প্রভাব পড়ছে। এসব কারখানার প্রায় সবগুলোই ভূগর্ভস্থ উৎসের পানি ব্যবহার করে। এসব কারখানা যদি আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে পানির ব্যবহার চার ভাগের এক ভাগও সাশ্রয় করতে সক্ষম হয়, তবে তাতে করে কেমিক্যালের ব্যবহারের মাত্রা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে যত বেশি পানি থাকে, তা ফুটাতে তাপ প্রয়োগের জন্য বেশি পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করতে হয়। তাই পানির ব্যবহার কমাতে পারলে মহামূল্যবান জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাসের ও সাশ্রয় হবে। শিল্প ও সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর উৎপাদন ও শিল্প উন্নয়নের পাশাপাশি ইকোসিস্টেমের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করা অতীব প্রয়োজনীয়। চলমান কভিড-১৯ মহামারি শুধু আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নের মূলেই আঘাত করেনি, পরিবেশ নিয়ে আমাদের অর্জনগুলো ধরে রাখতে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব স্থাপনার বিভিন্ন নির্ণায়কের মধ্যে রয়েছেÑটেকসই নির্মাণ ভূমি, জ্বালানি দক্ষতা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, নিরাপত্তা, পানি ব্যবহারের দক্ষতা, কর্মবান্ধব পরিবেশ, অভ্যন্তরীণ পরিবেশগত মান, কারখানার অভ্যন্তরে বায়ুর মান, প্রযুক্তির ব্যবহার, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, দুর্ঘটনা মোকাবিলার সক্ষমতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি। একটি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানায় উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে পানি, বিদ্যুৎ, রং এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব উপায়ে হচ্ছে কি না, তা দেখা হয়। অধিকাংশ পোশাকশিল্প কারখানা ইটিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে গতানুগতিক ইটিপির পরিবর্তে বায়োলজিক্যাল ইটিপি ব্যবহার করছে, যা আমাদের সবুজ বিপ্লবেরই একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত। বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে টেকসই উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করে তুলতে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থায় মনোযোগী হতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে অর্থায়নের পাশাপাশি এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল ও করপোরেট গভর্ন্যান্স (ইএসজি) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকে আরও গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের টেকসই ও স্বল্প কার্বনফুট প্রিন্ট সম্পন্ন পোশাকের প্রতি আগ্রহ ক্রমেই বেড়ে চলেছে এবং জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোও পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরির নিত্যনতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে কনজুমারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি অন্যতম স্বল্প কার্বন নিঃসরণকারী দেশ, তথাপি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করছে। বাংলাদেশের রয়েছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সোলার হোম সিস্টেম। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিজিএমইএ এরই মধ্যে ইএনএফসিসির উদ্যোগ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি চার্টার ফর ক্লাইমেট অ্যাকশনে স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে ২০৩০ সাল নাগাদ পোশাক খাতের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৩০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সহজলভ্যতা নিশ্চিতে বিজিএমইএ এবং টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। পোশাকশিল্পে সার্কুলার ফ্যাশন প্রণয়নে বিজিএমইএ, গ্লোবাল অ্যাকশন এজেন্ডা, রিভার্স রিসোর্সেসের সঙ্গে সার্কুলার ফ্যাশন পার্টনারশিপ তৈরি করেছে, পিফোরজির অর্থায়নে এই উদ্যোগের মাধ্যমে পোশাক কারখানায় উৎপাদিত উচ্ছিষ্ট রিসাইকেলের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং এ বিষয়ে শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে। এ ছাড়া বিজিএমইএ এলেন ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মেকিং ফ্যাশন সার্কুলার শীর্ষক নীতিমালা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
বাংলাদেশের শিল্পকারখানার মালিকরা এখন এসব বিষয়ে খুব সচেতন হচ্ছেন। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আগ্রহী হয়ে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। এরই মধ্যে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান পানি ও গ্যাস সাশ্রয়ে ইতিবাচক ব্যবস্থা নিয়েছে। পানি রিসাইক্লিনিংয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার ফলে শতকরা ২৪ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় হয়। অন্যদিকে ৫০ শতাংশ পানির অপচয়ও কমে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্পে এক নীরব সবুজ বিপ্লব ঘটেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর ব্যাপক প্রচার হয়নি এখনও। ফলে এটার ব্র্যান্ডিং হয়নি তেমনভাবে। বাংলাদেশ বর্তমানে পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি স্থাপনে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে। ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএস জিবিসি) সনদপ্রাপ্ত ৬৭টি গ্রিন ফ্যাক্টরি রয়েছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে সাতটি বিশ্বের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় বলা যায়। এছাড়া আরও প্রায় ২৮০টি কারখানা ইউএস জিবিসিতে নিবন্ধিত হয়েছে এবং আরও অনেক কারখানা পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরিতে রূপান্তর হওয়ার জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আমাদের গার্মেন্টশিল্প নানা সংস্কার, পরিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আর্থিক ক্ষেত্রে গ্রিন ব্যাংকিং ধারণার বিকাশ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছিল, বর্তমানে যা দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। টেকসই অর্থনীতির জন্য গ্রিন ব্যাংকিং ধারণার অনুসারী হয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে, যার চমৎকার ফলাফল ক্রমেই অর্থনীতিতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একইভাবে গার্মেন্টশিল্পে গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার পরিপূর্ণ বিকাশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নেবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। গ্রিন ফ্যাক্টরি কার্যক্রমকে বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের ব্যাপারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ ক্ষেত্রে চমৎকার গতির সঞ্চার হবে বলে আশা করা যায়।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক
জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন
আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: শব্দ এক ধরনের শক্তি, যা কোনো মাধ্যমের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং প্রাণীর শ্রবণের অনুভূতি জাগায় তাই শব্দ। প্রাণীর যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলো শব্দ। শরীরে স্বাভাবিক রক্ত সঞ্চালনের মতোই, আমাদের জীবনযাপনের জন্য শব্দ অপরিহার্য উপাদান। কিছু শব্দ আমাদের মনের ক্লান্তি দূর করে থাকে। যেমনÑপাখির কিচিরমিচির শব্দ, নদী বা সমুদ্র তরঙ্গের শব্দ। কিছু শব্দ আমাদের বিরক্তের কারণও বটে। শব্দ যখন মানুষের সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে বিরক্তি ঘটায় ও শব্দ যখন দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করে, স্বাস্থ্যের ক্ষতিসাধন করে, পরিবেশকে দূষিত করে তখন তাকে শব্দদূষণ বলে।
ঢাকা শহরে যানজট সমস্যার পাশাপাশি শব্দদূষণ একটি মারাত্মক সমস্যা। রাজধানী ঢাকায় শব্দদূষণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে তিনগুণ বেশি। আবাসিক, অনাবাসিক এলাকা, অফিসপাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি হাসপাতালের আশপাশেও শব্দদূষণের তীব্রতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম, যানবাহন ব্যবহারের ফলে শব্দের মাত্রা অসহনীয় হলে তা মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। প্রতিনিয়ত আমরা যেসব শব্দদূষকের মুখোমুখি হই, সেগুলো হচ্ছে-গাড়ির হর্ন, মাইকের শব্দ, নির্মাণকাজে ব্যবহƒত মেশিনের শব্দ, কলকারখানার সৃষ্ট শব্দ, হেলিকপ্টার বা বিমানের শব্দ ইত্যাদি। এছাড়া গায়ে হলুদ, বিয়ে, খৎনা, জš§দিন ও নববর্ষসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান উপলক্ষে অতি উচ্চমাত্রার শব্দ সৃষ্টিকারী সাউন্ড ব্যবহার করে বক্তব্য দেয়া হয় ও গান-বাজনার আয়োজন করে এবং আতশবাজি ফুটিয়ে তীব্র শব্দের উৎপত্তি করে শব্দদূষণ করা হয়। তাছাড়াও ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ এর রাতে (থার্টিফার্স্ট নাইটের নামে) চারদিকে আতশবাজির শব্দ আর আগুনের ফুলকি ঢাকায় শব্দ ও বায়ুদূষণ দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় চলে গিয়েছিল। শব্দদূষণে বিশ্বে শীর্ষে বাংলাদেশ, এ তথ্য উঠে এসেছে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) ২০২২ সালের প্রতিবেদনে। যেখানে বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দদূষণের মাত্রা তুলে বিশ্লেষণ করা হয়। ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন বলছে, ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল, যা অন্য শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। রাজধানীসহ অন্য শহরগুলোতে প্রতিনিয়তই মোটরচালিত যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্নের মাধ্যমে শব্দদূষণের শিকার হচ্ছে নিরীহ মানুষ। উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ কানে কম শোনা থেকে শুরু করে স্থায়ীভাবে বধির হচ্ছে। এই সমস্যায় ভোগা মানুষ সবচেয়ে বেশি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের। ঢাকার কাছের এই বিভাগের ৫৫ শতাংশ মানুষ শব্দদূষণের শিকার। সিলেটে প্রায় ৩১ শতাংশ, ঢাকায় ২২ দশমিক ৩ শতাংশ, রাজশাহীতে প্রায় ১৪ শতাংশ রাজপথে কর্মরত পেশাজীবী শব্দদূষণে ভুগছেন। ঢাকাসহ ৫টি সিটি করপোরেশনে প্রায় ৪২ ভাগ রিকশাচলকই এই শব্দদূষণের শিকার। এছাড়া প্রায় ৩১ ট্রাফিক পুলিশ, ২৪ শতাংশ সিএনজি চালক, ২৪ শতাংশ দোকানদার, ১৬ শতাংশ বাস, ১৫ শতাংশ প্রাইভেট কার এবং ১৩ শতাংশ মোটরসাইকেল। এসব সমস্যায় ভোগাদের ৭ শতাংশের শ্রবণ সহায়ক যন্ত্র (কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট) ব্যবহার জরুরি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সাইয়েন্সের ‘বাংলাদেশের রাজপথে শব্দদূষণ এবং শব্দদূষণের কারণে রাজপথে কর্মরত পেশাজীবীদের শ্রবণ সমস্যা’ নিয়ে করা অতিসম্প্রতি এক গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে। এছাড়া ঢাকায় ট্রাফিক বিভাগের কর্মরতদের ৫৬.৪% ভাগ পুলিশ কানে কম শোনেন, এর মধ্যে শ্রবণশক্তি স্থায়ীভাবে হারানোর পথে ৯.৫%, এই গবেষণা তথ্য প্রকাশ করেছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত শব্দদূষণের মাত্রা ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবলের কথা উল্লেখ করা থাকলেও কিন্তু ঢাকা শহরে শব্দদূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের কানের স্বাভাবিক শ্রবণ ক্ষমতার চেয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ গুণের বেশি শব্দ শোনা যায়। এতে করে জনস্বাস্থ্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। মানুষের ব্যক্তিগত অদূরদর্শী কার্যকলাপ, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপরিকল্পিত বিস্তার, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, যাতায়াত ব্যবস্থার ত্রুটি ও ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকারের বিবর্তিত শব্দের ব্যাপকতায় শব্দদূষণ বর্তমান সময়ে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এমনকি এক শ্রেণির মোটরগাড়ির চালকদের অহেতুক, অকারণে বিরামহীন হর্ণ বাজানো একটা নেশা কিংবা চালকদের হাম্বড়া ভাবের অনাকাক্সিক্ষত ঔদ্ধত্য প্রকাশে! যার অন্যতম শিকার হয় অসুস্থ ব্যক্তিসহ সব বয়সের মানুষ।
শরীরের এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যেটি শব্দদূষণে আক্রান্ত হয় না। তবে, শব্দদূষণে তাৎক্ষণিকভাবে আক্রান্ত হয় মানুষের কান। কানের ওপর শব্দদূষণের প্রভাব মারাত্মক। উচ্চ শব্দে মানুষ যদি বেশি সময় ধরে থাকে, সে সাময়িকভাবে বধির হয়ে যেতে পারে। হাইড্রোলিক হর্নের কারণে শব্দদূষণের মানমাত্রা ১২০ থেকে ১৩০ পর্যন্ত উঠে যায়। গবেষণা দেখা গেছে, কোনো মানুষকে যদি ১০০ ডেসিবেল শব্দের মধ্যে রেখে দেয়া হয়, তাহলে ১৫ মিনিটের বেশি সময় থাকলে তার শ্রবণক্ষমতা একেবারে হারিয়ে যেতে পারে। একজন মানুষকে যদি আট ঘণ্টা করে ক্রমাগত ৬০ থেকে ৮০ ডেসিবেল শব্দের মাঝখানে রেখে দেয়া যায়, এক বছরের মাথায় লোকটি বধির হয়ে যাবেন। মানুষের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের অন্যতম ইন্দ্রিয় কান। একজন কর্মক্ষম মানুষ যখন বধির হয়ে যান, তখন তিনি নিজের জন্য একটি বোঝা, পরিবার ও সমাজের জন্য বিড়ম্বনা। যেকোনো ধরনের শব্দদূষণ সন্তানসম্ভবা মায়ের জন্য গুরুতর ক্ষতির কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, লস এঞ্জেল্স, হিথ্রো এবং ওসাকার মতো বড় বিমানবন্দরের নিকটবর্তী বসবাসকারী গর্ভবতী মায়েরা অন্য জায়গার চেয়ে বেশি সংখ্যক পঙ্গু, প্রতিবন্ধী ও অপুষ্ট শিশুর জš§ দেয়।
শব্দদূষণ (প্রায়) ৩০টি রোগের কারণ। শব্দদূষণের ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাস, কার্যক্ষমতা কমে যায়, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, শরীরের রক্তচাপ বৃদ্ধি করে, হƒদযন্ত্রের কম্পন বাড়িয়ে দেয়, হজম প্রক্রিয়া ব্যাহত করে, মাথা ধরা, মানসিক অশান্তি, মাংসপেশীর খিঁচুনি সৃষ্টি করে এবং ঘুমের সমস্যা দেখা দেয় এবং সর্বোপরি শিশুদের বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত করে। অথচ নগর জীবনের অধিকাংশ সময় আমাদের অসহনীয় শব্দের সঙ্গে বাস করতে হচ্ছে। ক্রমাগত শব্দদূষণের ফলে কানের টিস্যুগুলো আস্তে আস্তে বিকল হয়ে পড়ে তখন সে স্বাভাবিক শব্দ শুনতে পায় না। তীব্র শব্দে কানের পর্দা ছিঁড়ে বধির হয়ে যেতে পারে, শিশুদের মধ্যে মানসিক ভীতি দেখা দেয়। মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে মানুষের কারোনারি হার্ট ডিজিজ হতে পারে। শব্দদূষণের ফলে সাময়িক রক্ত প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়। এছাড়া কণ্ঠনালির প্রদাহ, আলসার, পেপটিক আলসার এবং মস্তিষ্কের রোগ হতে পারে।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোর মানুষ বর্তমানে অতিমাত্রায় শব্দদূষণে আক্রান্ত। রাজধানী শহর ঢাকার এমন কোনো নাগরিক হয়তো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে যে, শব্দদূষণের শিকার হয়নি। শিশু, নারী-বৃদ্ধরা এদিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন। জনগোষ্ঠীর বিশাল একটা অংশ আজ শারীরিক এবং মানসিক উভয় প্রকার স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে এবং পরবর্তীতে নানা রকম জটিলতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে, ফলে বাড়ছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
দেশের ৯টি স্থানের একটি করে এলাকাকে নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যদিও সব এলাকাকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কারণ শব্দদূষণের কারণে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। শব্দদূষণ রোধের জন্য আমাদের দেশে আইনের কমতি নেই। কিন্তু কোথাও শব্দদূষণ সহনীয় মাত্রা রাখা যাচ্ছে না। কারণ আইন প্রয়োগের কমতি রয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সংস্থা (বেলা) ২০০২ (খ্রি.), শব্দদূষণ বন্ধে আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ মার্চ উচ্চ আদালত হাইড্রোলিক হর্ন এবং বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী যেকোনো ধরনের হর্ণ গাড়িতে সংযোজনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং গাড়িতে বাল্ব হর্ণ সংযোজনের নির্দেশ প্রদান করে। এই আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে শাস্তির বিধানও প্রচলিত আছে।
এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬ এর ২৫, ২৭, ২৮ ধারামতে শব্দদূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড উভয়েরই বিধান রয়েছে। মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ১৩৯ এবং ১৪০নং ধারায় নিষিদ্ধ হর্ন ব্যবহার ও আদেশ অমান্য করার শাস্তি হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। ১৯৯৭ সালের পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী নীরব এলাকায় ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবল এবং রাতে ৩৫ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫০ ডেসিবল এবং রাতে ৪০ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ডেসিবল ও রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ডেসিবল ও রাতে ৬০ ডেসিবল এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ডেসিবল ও রাতে ৭০ ডেসিবলের মধ্যে শব্দের মাত্রা থাকা বাঞ্ছনীয়। এই আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে একশ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে নীরব এলাকা চিহ্নিত করা হয়। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী, নীরব এলাকার জন্য শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা ৫০ ডেসিবল নির্ধারিত হয়েছে।
সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। এই আইনের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের অধিকার ও কর্তব্য এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো লিপিবদ্ধ আছে। বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৮ বলা হয়েছে, জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন। জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনের কথা বলা হলেও সংবিধানে স্পষ্টভাবে স্বাস্থ্যকর পরিবেশকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। কিন্তু সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ এবং ৩২ এই দুটি অনুচ্ছেদে জীবনের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে জীবনের অধিকার বলতে স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অধিকারকে অন্তর্ভুক্তি করা হয়। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ড. মহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য মামলার [৪৮ ডিএলআর (১৯৯৬) পৃষ্ঠা.৪৩৮ এবং ১৭ বিএলডি (১৯৯৬) (এডি) পৃষ্ঠা.১] রায়ে বলেন, বাংলাদেশ সংবিধানে উল্লেখিত মৌলিক অধিকার হিসেবে জীবনধারণের অধিকার বলতে সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশে বাঁচার অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। এছাড়া ইন্ডিয়ান সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে, সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশে বাঁচাকে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে; এবং ইন্ডিয়ান মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ফোরাম ফর প্রিভেনশন অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সাউন্ড পলিউশন বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া {১ এআইআর (২০০৫) (এসসি) ৩১৩৬} মামলায় লাউড স্পিকারের মাধ্যমে সৃষ্ট শব্দদূষণকে সংবিধানে প্রদত্ত মতপ্রকাশের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে।
শব্দদূষণ প্রচলিত আইনের পরিপন্থি। শব্দদূষণ রোধ করার জন্য সরকার হাইড্রোলিক হর্ণ আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু এরপরও শব্দদূষণ কমছে না বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। অথচ এ আইনের তোয়াক্কা কেউ করে না। আইন থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ না থাকার কারণে দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে, ফলে অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, চিকিৎসা ব্যয় হ্রাস এবং এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য শব্দদূষণ রোধ করা অতীব জরুরি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে নানা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সময়ের দাবি। এই জন্য সরকারের যথাযর্থ কর্তৃপক্ষ বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনগণকে শব্দদূষণের অপকারিতা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। শুধু গাড়ির হর্ন কমানো গেলেই শব্দদূষণের পরিমাণ ৮০ ভাগ কমে যাবে। এই মারাত্মক ঘাতক থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকমণ্ডলী ও শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন। শব্দদূষণের প্রকোপ কমাতে হলে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে আমাদের প্রত্যেককে শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংযমী হতে হবে। এছাড়া বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন ও শিক্ষিত সমাজকে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে। স্বাস্থ্য এবং জীবনযাত্রার মানের ওপর শব্দের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতি বছর ২৭ এপ্রিল আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস উদযাপন করা হয়। ২০২২ সালে দিবসের প্রতিপাদ্যÑ‘চৎড়ঃবপঃ ণড়ঁৎ ঐবধৎরহম, চৎড়ঃবপঃ ণড়ঁৎ ঐবধষঃয’. তাই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস, চিকিৎসা ব্যয় কমাতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজম্মের সঠিক বিকাশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।
আইনজীবী
masumbillahlaw06@gmail.com