Print Date & Time : 27 July 2025 Sunday 7:51 pm

সার্কের ভবিষ্যৎ কি অনিশ্চিত থেকে যাবে!

মোহাম্মদ এনামুল হক : আজ ৮ ডিসেম্বর সার্ক সনদের চুক্তি স্বাক্ষর দিবস। সার্ক অনেক প্রত্যশা নিয়ে গঠিত হয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধকালীন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক সংগঠনের উদ্ভব ও প্রসার ঘটে। এই আঞ্চলিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠার পেছনে বিশ্বরাজনীতিসহ নানা নিয়ামক কাজ করছিল। তেমনি দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সংস্থা হিসেবে সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন বা  দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ৭টি দেশ নিয়ে যাত্রা শুরু করছিল সার্ক। প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য রাষ্ট গুলো, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ। পরবর্তীতে আফগানিস্তান সার্কের সদস্য হয়।এই রাষ্ট্রগুলোর ভৌগোলিক ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে এদের মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে।

নিজেদের পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহযোগী, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পারস্পরিক সহযোগিতা, শিক্ষা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, কারিগরি ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের উদ্দেশ্যে সার্ক গঠিত হয়েছিল। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো এই অঞ্চলের উন্নয়ন ও মানুষের কল্যাণের জন্য সার্ক গঠিত হলেও আজ তা বিলুপ্ত প্রায়।

সার্ক আজ সময়ের পরিক্রমায় অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেছে। যদিও সার্কের অনেক সফলতা আছে, তব্ওু ব্যর্থতা চোখে পড়ার মতো। সার্কের এই ব্যর্থতার পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো সার্কের সনদে দ্বিপক্ষীয় কোনো সমস্যা ও রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে সমস্যা ও রাজনৈতিক অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সার্ক অক্ষম ছিল। অথচ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসন করে শান্তি স্থাপন করা আঞ্চলিক শান্তি ও অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সামঞ্জস্যহীন সম্পর্ক সার্কের ব্যর্থতার আরেকটি অন্যতম কারণ অর্থাৎ অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ভারতের বেশি তাই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভারতের বড় সুলভ আচরণ করে আসছে। এই অঞ্চলের ৭১ শতাংশ ভূখণ্ড, জিএনপির ৭৯ শতাংশ, বাণিজ্যের ৫৯ শতাংশ, জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ ও বিশ্বের চতুর্থ সামরিক শক্তিশালী রাষ্ট্র দেশ।

ভারত-পাকিস্তান সার্কের দুইটি শক্তিশালী ও অন্যতম সদস্য। কিন্তু রাষ্ট্র দুইটার মধ্যে জš§লগ্ন থেকে বিরোধ, অবিশ্বাস ও কাশ্মীর নিয়ে রেষারেষি সার্কের সফলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

চীন ও আমেরিকার প্রভাব বিস্তারে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি। চীন তার বেল্ড অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ পরিকল্পনার জন্য এই অঞ্চলের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে এই অঞ্চলের প্রায় দেশে তার অর্থনৈতিক বিস্তার হয়েছে। পাকিস্তান চীনের অন্যতম মিত্র রাষ্ট্র। অন্যদিকে ইন্দো প্যাসেফিক অঞ্চলের বিভিন্ন কৌশলগত নীতিতে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সহযোগী দেশ। এই দুই শক্তিশালী দেশ তাদের স্বার্থের পরিপন্থি কোনো সিদ্ধান্তকে বিভিন্নভাবে রোধ করে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। যেহেতু ভিন্ন স্বার্থ রয়েছে রাষ্ট্র দুইটির, তাছাড়াও একে অন্যের প্রভাব বিস্তাররোধে সবসময় চেষ্টা করে, যা সার্কের ব্যর্থতাকে তরান্বিত করেছে।

সার্কের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো কম শুল্কে বাণিজ্য করা ও বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৪ সালে ইসলামাবাদ সম্মেলনে সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়া (সাফটা) চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। কিন্তু পরে তা আলোর মুখ দেখেনি। এই নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করলেও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অনিচ্ছায় সাফটা চুক্তি অকাল মৃত্যু ঘটে, যা সার্কের প্রধান ব্যর্থতার একটি। অধিকন্তু, নিয়মিত সার্ক সম্মেলনের আয়োজন করতে ব্যর্থ হয়েছে সার্ক।

অদূর ভবিষ্যতে সার্কের ভবিষ্যৎ এখন বলতে গেলে অন্ধকার। অন্যদিকের সার্কের বিপরীতে ভারতের উদ্যোগে গঠিত হয় বিমেসটেক যার সদস্য রাষ্ট্র হিসাবে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, মিয়ানমার, ভুটান, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা রয়েছে এখানে সার্কের অধিকাংশ রাষ্ট্র থাকলে নেই পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ। অনেকেই সার্কের এই অন্ধকার সময়ে বিকল্প হিসেবে বিমেসটেককে চিন্তা করছে। কিন্তু তা কতটুকু সফল হতে কিছু রাষ্ট্রকে বাইরে রেখে তা প্রশ্ন থেকে যায়? সার্ককে অনেক গবেষক মৃতদেহের সঙ্গে তুলনা করছে। যার অস্তিত্ব থাকলে প্রাণ নেই। পৃথিবীর অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আসিয়ান ও আফ্রিকান ইউনিয়নের সফলতা আজ সেসব আঞ্চলিক উন্নয়নে অগ্রসর ভূমিকা পালন করে আসছে। ওই আঞ্চলিক সংস্থার মতো দক্ষিণ এশিয়ার এই আঞ্চলিক সংস্থা ভূমিকা রাখতে পারত। তবুও, এখনও আশার আলো দেখতে পারি যদি সার্কভুক্ত রাষ্ট্র প্রধানদের আন্তরিক প্রচেষ্টা দিয়ে সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করে। ভারত ও পাকিস্তান এই অঞ্চলের সামগ্রিক সাফল্যের কথা চিন্তা করে। ভারত এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অন্যথায় আশা শুধু আশা থেকে যাবে সার্ক হারিয়ে যাবে অতল গহ্বরে, যা এই অঞ্চলের জন্য অকল্যাণ ছাড়া কল্যাণ বয়ে আনবে না। অধিকন্তু, এই অঞ্চলের দেশগুলো চীন ও আমেরিকার প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে পরে আর ঐক্য সৃষ্টি সম্ভব হবে না,  যা এই অঞ্চলের শান্তি বিনষ্ট করবে এবং সংঘাতের জš§ দেবে।

শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়