ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা।
পর্ব-১…
মিজানুর রহমান শেলী: বাংলাদেশে নির্মাণ ও আবাসনশিল্পের সঙ্গে ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা ও সমাজসেবী জহুরুল ইসলামের নাম জড়িয়ে রয়েছে। এই সৃজনী, স্বনির্মিত উদ্যোক্তা জন্ম ছিলেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের ভাগলপুর গ্রামে। সালটা তখন ১৯২৮। পহেলা আগস্ট। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গতির উচাটানে রাজধানী ঢাকা কখনও বা কোলাহলপূর্ণ আবার কখনও বা হয়েছে জনশূন্য। ব্রিটিশমুক্ত এই বাংলা যখন নিজেদের ভাগ্য নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠল, স্বপ্ন দেখল, তখন আবারও সেই মোগল আমলের তারুণ্যযুগের মতোই ঢাকায় লোকসংখ্যা বাড়তে থাকল। ব্যবসা-বাণিজ্যে উষ্ণ-চঞ্চল হাওয়া দোলা দিল। এ সময়টা ছিল জহুরুল ইসলামের জীবনেরও তারুণ্য। কিছু করার সময়।
তবে তিনি ছোট কিছু করার নেশায় থিতু হয়ে থাকেননি প্রথমকার চাকরি জীবনে। আবার এই সরকারি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান সিঅ্যান্ডবি’র চাকরিকে তিনি তাচ্ছিল্যের চোখেও দেখেননি। এখানকার চাকরি তার জীবনে দুটি কারণে অনিবার্য হয়ে ওঠে। প্রথমটি হলো, পড়ালেখা শেষ করার পর নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে অর্থ জোগান দেওয়া। আর দ্বিতীয়টা হলো, ভবিতব্য জীবনের ঠিকাদারি ব্যবসায় নিজেকে যোগ্য, দক্ষ বা প্রশিক্ষিত করে তোলা।
এভাবে জহুরুল যেমন তার নিজ জীবনকে সাজিয়ে নিতে প্রাগ্রসর, ঠিক তখনই এই ঢাকা আবার রাজধানীর মর্যদা ফিরে পেল। এমনকি পাকিস্তানের মতো একটি স্বাধীন ও আধুনিক রাষ্ট্রের রাজধানী হয়ে উঠল। জীর্ণশীর্ণ কিছুসংখ্যক মানুষের যাপিত জীবনে আবার ফিরে এলো সঞ্জীবনী শক্তি। সঞ্চারিত হলো আর্থিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের আশা ও নেশা।
ঢাকার এই বিপ্লবকে জহুরুলের জীবনে কোনো ধরণের তত্ত্ব-কাঠামোয় মূল্যায়ন করা চলে কিনা- তা নিয়ে ঢের আলাপ-আলোচনা, বিতর্ক বা ডিসকোর্সের সুযোগ থাকে। সুযোগ থাকে রাজধানী ঢাকার বিবর্তনিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে এখানকার লোকসংখ্যা, নগর বিস্তৃতি ও অবকাঠামোগত পরিবর্তনের হালহকিকত বিশ্লেষণের। ব্রিটিশ-পরবর্তী পাকিস্তান আমলেই মূলত বর্তমান এই আধুনিক ঢাকা নগরীর নবরূপে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এই অগ্রযাত্রা ধাবমান হয়েছে। এখনো এই রাজধানীর বিস্তরণ, জনসংখ্যার প্রবাহ ও আর্থিক-প্রশাসনিক অবকাঠামো প্রায় একটি নির্দিষ্ট ধারাতে চলমান রয়েছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন সময় কিংবা তার পরবর্তী সময়ে কিছু ছন্দপতন বা সংকট এই ঢাকাকে মাড়াতে হয়েছিল। এটা সত্যÑকিন্তু এই সংকট রাজধানী ঢাকার নির্মাণচিত্রে নতুন দায়-দায়িত্ব আর প্রশাসনিক কর্তৃত্ব এনে দেয়। এতটুকু বাদ দিলে বলা চলে এই ঢাকার নির্মাণ আর গৃহায়নে একটি চলমানতা অব্যাহত রয়েছে। পাকিস্তান আমলে জহুরুল ইসলামের মতো যে উদ্যোক্তারা নগর নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন, সেই সাহসী বাঙালিরাই আবার বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
১৯৪৭ সালের পর থেকে এখানকার আর্থিক উন্নয়নে যেসব ব্যবসায় উদ্যোক্তার অবদান রয়েছে, তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানটাও বিবেচনা যোগ্য। কেননা ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই এখানে একটি ধর্ম ও জাতিগত সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব উসকে ওঠে। ব্রিটিশ রাজেরা নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পূর্বেকার মুসলিম শাসন আর তাদের সাংস্কৃতিক পরিবেশ পরিস্থিতিকে অবদমিত করে রেখেছিল। তাই এখানে তারা হিন্দু আর মুসলিমদের মধ্যে একটি জাতিগত প্রতিযোগিতা সামনে আনে। এমনকি মুসলিম এবং মুসলিমদের মধ্যেকার সম্ভ্রান্ত লোকদের পাশ কাটিয়ে একটি নতুন দল বলয় তৈরি করে। যারা ব্রিটিশের শাসনের জন্য নিরাপদ ছিল। এই নবনির্মিত গোষ্ঠীর বেশিরভাগই ছিল হিন্দু। কেননা মুসলিমরা তাদের জাত্যাভিমান আর হারানো ক্ষমতার কষ্টে ব্রিটিশ শাসন মেনে নেয়নি। তাছাড়া ব্রিটিশরাও চায়নি, যে মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তারা এই ভারত অধিকার করেছিল, সেই মুসলিমরা পড়ালেখা শিখে কিংবা আর্থিক কাঠামোয় এগিয়ে এসে তাদের সঙ্গে কাজ করে নিজেদের উন্নতি করে নিবে। কেননা মুসলিমদের উন্নয়ন মানেই ছিল ব্রিটিশদের জন্য আপদ। এ ক্ষেত্রে হিন্দুরা ছিল তাদের জন্য নিরাপদ। আর হিন্দুরা আগে থেকেই মুসলিম শাসনের অধীনে শত শত বছর পাড়ি দিয়ে এসেছিল এই ভারতে। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসনের প্রাক্কালে তারা অন্তত হাওয়া বদলের স্বাদ পেয়েছিল। ব্রিটিশের ইশারায় তারা শিক্ষা ও আর্থিক কাঠামোতেও সামনে এগিয়ে আসা শুরু করে। ফলে ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনে মুসলিমরা পিছিয়ে পড়ে। আর হিন্দুরা এগিয়ে আসে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলিম এই জাতিগত (ধর্মীয় নয়) বিভাজনে যখন আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন হলো, তখন মুসলিমরা আবার ব্যবসায় কাজে এগিয়ে আসা শুরু করে। শিক্ষা-দীক্ষাতেও তারা আবার নতুনভাবে আন্দোলিত হলো। তবে ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিক থেকেই মুসলিমদের মধ্যেও জাত্যাভিমান ভুলে ইংরেজি শিক্ষা নেওয়া, ব্রিটিশের চাপরাশ গলায় পরা এবং আর্থিক কাঠামোতে এগিয়ে আসার প্রবাহ শুরু হয়েছিল। এই প্রবাহটা কার্যত বঙ্গভঙ্গের পড়ে সবচেয়ে বেশি দানা বাঁধে। এটিও ব্রিটিশের বিভাজন ও শাসন নীতির অনুকূলে ছিল। যাহোক, এই ১৯০৫ সালের পর থেকেই বহু বাঙালি মুসলিম জ্ঞান ও আর্থিক কাঠামোয় প্রাগ্রসর হলেন।
বলে রাখা ভালো, এই বাংলা অঞ্চলের মুসলিমরা অবশ্য আর্থিক কাঠামোয় ১৯৪৭-এর আগে এগিয়ে আসেনি, যতটা না পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিমরা এগিয়ে এসেছিল। এর ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির পরে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে তেমন ভালো ব্যবসায়ী কিংবা ব্যবসায় উদ্যোক্তা পাওয়া যায়নি। তাই তখনো, হয় বাঙালি হিন্দু উদ্যোক্তারা অথবা পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলিমরা ব্যবসায় আধিপত্য করেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতির মধ্যেও যেসব বাঙালি মুসলিম উদ্যোক্তা সামনের সারিতে এগিয়ে আসেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল নি¤œ বা নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের।
এখানে সেখ আকিজ উদ্দিনের নাম বলতেই হয়। তিনি একেবারেই নি¤œ আয় তথা ভূমিহীন গ্রাম্য পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ। যার কোনো সামাজিক অবস্থান কিংবা আর্থিক কাঠামো ছিল না। এদিক দিয়ে জহুরুল ইসলামকে একই সময়ের বিবেচনায় ভিন্ন প্রেক্ষিতে দেখতে হয়। কেননা তিনি ছিলেন মোটমুটি সচ্ছল পরিবারের সন্তান। মুসলিমদের আদি শিক্ষায় তার বাবা ও দাদাও ছিলেন শিক্ষিত। ফলে সেখ আকিজ উদ্দিনের কাতারে জহুরুল ইসলামকে মাপলে চলবে না। প্রসঙ্গত, নি¤œবর্গীয় ধারণাটিকে ঠিক ব্যক্তি মানুষের আত্মবিচারের বাইরে তকমা লাগিয়ে দেওয়া চলে না। যদি চলত তবে সেখ আকিজ উদ্দিনকে হয়তো নি¤œবর্গীয় বলা যেত। কেননা, সেখ আকিজ উদ্দিন তার চিন্তা কাঠামোয় নিজেকে কখনো নি¤œবর্গীয় ভাবেননি। যাহোক, জহুরুল ইসলাম নিজেকে নি¤œবর্গীয় ভেবেছেন কিনা সে প্রশ্ন উত্থাপনের আগেই এটা মিটমাট করা সম্ভব। কেননা, রণজিত গুহর ব্রিটিশ ভারতের প্রেক্ষিতে সৃষ্ঠ সাবলটার্ন বা নি¤œবর্গীয় তত্ত্ব অনুসারে জহুর’লের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান এই গবেষণায় বিবেচনা করা হয়েছে। তাতে বোঝা গেছে, জহুর’লকে নি¤œবর্গীয় সমাজের মানুষ বলা চলে না। তবে জহুরুল ইসলামের পরিবারে ছিল অসচ্ছলতা, টানাপড়েন। আবার গ্রামের মধ্যে তারা একটি ভালো গোষ্ঠীর হলেও, একই গ্রামে ছিল আহমেদ রাজার জমিদার পরিবার। ফলে জমিদার পরিবারের পাশেই এক চিলতে টিনের ঘরে বেড়ে ওঠা জহুরুলকে সামাজিক অবস্থানে বড় করেও মাপা চলে না। অর্থ কিংবা সমাজ সব অবস্থানে থেকেই জহুরুল ইসলাম ছিলেন এক দোলাচলে আবদ্ধ দশায়। এই পরিস্থিতি তার মাঝে যেমন মান রক্ষার, তেমনি পেট রক্ষার জিদ জাগিয়ে তুলেছিল।
তাই জহুরুল পেট রক্ষার দায়ে চাকরি নেন। আবার মান রক্ষার দায়ে চাচার সঙ্গে বাজি রেখে বলেছিলেন, কাকা যেমন বাড়ি করেছেন, অমন বাড়ি আমি প্রতি বছর একটি করে বানাব। এ ধরনের আত্মবিশ্বাস নিয়ে অবশ্য সেখ আকিজ বেড়ে উঠেছিলেন না। সেখ আকিজ ছিলেন জহুরুলের সমসাময়িক ব্যবসায় উদ্যোক্তা। যার ৭৭ বছরের জীবনে ৬৮ বছর কেটেছে ব্যবসায়। তিনি কেবল পেটের দায়েই বড় হয়েছেন। তারপর তার অর্জিত সব সম্পদ নিয়ে কখনও নিজের অর্জনের দম্ভ করেননি। তিনি বড় হওয়ার স্বপ্ন কখনও দেখেননি। কেবল আজ আর আগামীকাল কী করবেনÑএই ছিল তার পরিকল্পনা।
এ জায়গা থেকে বিশ শতকের গোড়ার দিকে বেড়ে ওঠা বাঙালি মুসলিম উদ্যোক্তাদের মধ্যে জহুরুল ইসলাম ছিলেন পাকিস্তান সৃষ্টির পরে বাঙালির স্পর্ধিত হƒদয়ের প্রতিচ্ছবি। আর আকিজ ছিলেন ব্রিটিশের নাগপাশে কষ্টার্জিত বিপ্লব। জহুরুল ইসলাম রাজনৈতিক সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের অনুকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠা এক সৃজনী মানুষ। এক স্পর্ধিত বাঙালি মুসলিম ব্যবসায় উদ্যোক্তা। যার নাম রাজধানী ঢাকার গৃহায়ন, নির্মাণশিল্পেও সাথে যেমন জড়িত, তেমনি অদক্ষ শ্রমিকের হাতে এ দেশের রাজস্ব আয়ের সঙ্গেও সোনালি আভায় ভাস্বর। ঢাকার ৪০ শতাংশ গৃহায়ন হয়েছে তার হাতের পরশে। বড়, প্রসিদ্ধ প্রশাসনিক কাঠামো থেকে শুরু করে তিনি গড়ে তুলেছেন মধ্যবিত্তের স্বপ্নের আবাসন। সেসব কীর্তিকর্ম এ গবেষণা গ্রন্থে বিশ্লেষিত হয়েছে।
লেখক:
গবেষক, শেয়ার বিজ।