শেখ রিফাদ মাহমুদ: বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থার সর্বনিন্ম স্তর হচ্ছে গ্রাম আদালত। গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ আইনের ধারা ৫ অনুযায়ী একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষ কর্তৃক মনোনীত দুইজন করে মোট চারজন সদস্য নিয়ে গ্রাম আদালত গঠিত হয়। তবে গ্রাম আদালতের বাইরে গ্রামাঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সালিশি ব্যবস্থা বিদ্যমান। ছোটখাটো ঝগড়া-বিবাদ, মারামারির ঘটনার মীমাংসা হয় এ সালিশের মাধ্যমে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সালিশ বিতর্কিত হয়। এমন গ্রাম্য প্রহসনমূলক সালিশ আধুনিক সমাজের অন্যতম ট্যাবু। অধিকাংশক্ষেত্রেই দেখা যায়, সালিশ করতে গিয়ে কর্তারা উৎকোচ গ্রহণ করেন। অবৈধ অর্থ লেনদেনের ফলে সালিশের রায় পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে। যার ফলে অপরাধ করেও অর্থের প্রভাবে ক্ষমা পেয়ে যান অপরাধীরা। গ্রাম্য সালিশি ব্যবস্থায় পক্ষপাতিত্ব, রাজনীতি ও অবৈধ অর্থের লেনদেন ঢুকে পড়া এমন প্রহসনের প্রধান কারণ।
বর্তমান সময়ের গ্রাম্য রাজনীতির ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। আবার অনেককে গ্রাম পর্যন্ত ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। ক্ষমতার দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন এলাকার গণ্যমান্য প্রবীণরাও। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলেই উল্টো বিপদে পড়তে হয়, নিরীহ মানুষ শিকার হন ভোগান্তির। গ্রাম্য সালিশ চক্রে এলাকার ক্ষমতাসীনরা প্রভাব বিস্তার করে। ইউপি সদস্য, ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি-সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন মিলে সালিশ কার্যক্রমের আয়োজন করেন। অবৈধ অর্থ লেনদেনের ফলে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে আর্থিকভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠছেন কথিত বিচারকরা। যাদেও অনেকেরই ছিল না সামাজিক কোনো ভিত্তি। কিন্তু বর্তমানে গায়ের জোরে, ক্ষমতার প্রভাবে তারাই সেজেছেন সমাজের কর্তা।
মূলত আদালতে বিচারের উদ্দেশ্যে মামলা চালানোর ভয়ে অনেকেই আদালতে যেতে চান না। গ্রামের প্রতারক শ্রেণির লোকের খপ্পরে পড়ে কেউ কেউ আদালতে না গিয়ে গ্রাম্য সালিশের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েন। হত্যা, মারপিট, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, দখল ইত্যাদি মারাত্মক অপরাধগুলোর বিচার ও নিষ্পত্তি গ্রাম আদালত বা সালিশের কাজ না হলেও বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গ্রাম আদালত এ ধরনের বিচারও করছে। বিচারের নামে দুই পক্ষ থেকেই নেয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। যে বেশি টাকা দিতে পারে রায় যায় তার পক্ষে।
এক ইউপি সদস্য বলেই ফেললেন, নির্বাচন বাবদ খরচা করেছি ১৫ লাখ; দুই মাস সালিশ করলেই সে টাকা উঠে আসবে। অনেক ক্ষেত্রে সালিশের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করে খেয়াল-খুশিমতো সিদ্ধান্ত দেন।
গত জুলাইয়ে কুমিল্লার লালমাই উপজেলায় ৯ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর অভিযুক্তকে ৫ হাজার জরিমানা করে ঘটনার ‘সমাধান’ করেছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ঘটনাটি ঘটেছিল লালমাই উপজেলার পেরুল দক্ষিণ ইউনিয়নের গজারিয়া ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামে। ৯ বছরের এক মেয়ে শিশুকে ধর্ষণ করে একই বাড়ির আব্দুল মতিন (৬৫)। অভিযুক্ত মতিন সম্পর্কে মেয়েটির দাদা। প্রথমবার ধর্ষণের পর কাউকে এ ঘটনা বললে শিশুটিকে গলা কেটে হত্যার হুমকিও দেয় সে। এসব ভয় দেখিয়ে শিশুটিকে আবার ধর্ষণ করে মতিন। পরে শিশুটির রিকশাচালক বাবা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যকে ঘটনাটি জানিয়ে বিচার দাবি করেন। পরে সে ঘটনার বিচারের জন্য সালিশ বৈঠক বসে। সে সালিশে স্থানীয় প্রভাবশালী ও ইউপি সদস্য মিলে নির্যাতিত মেয়েটির সাক্ষ্য নেন এবং ধর্ষক মতিনের স্বীকারোক্তিতে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও প্রথমে তারা মতিনকে ৫০ বার কানে ধরা ও ১০০ বেত্রাঘাতের সিদ্ধান্ত নেয়। কিছুক্ষণ পরেই আবার সিদ্ধান্ত পাল্টে অভিযুক্ত মতিনকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এরপর সালিশদাররা মেয়েটির পরিবারকে এ ঘটনায় কোনো মামলা বা অভিযোগ করতেও নিষেধ করেন।
গত মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় সালিশ বৈঠকে বাগবিতণ্ডার জেরে বল্লমের আঘাতে প্রাণ হারান এক ব্যবসায়ী। স্থানীয় দুই ব্যক্তির মধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়। বিষয়টি মীমাংসা করতে এলাকায় সালিশ বৈঠক ডাকা হয়। সালিশে বাগবিতণ্ডার জেরে দেশীয় অস্ত্রসহ নিয়ে হামলায় ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়।
গত বছরের জুন মাসে পটুয়াখালীতে সালিশ করতে গিয়ে নিজেই বিয়ে করেছিলেন এক ইউপি চেয়?ারম্যান। সে সময় মেয়ে নিজের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে বাড়ি থেকে প্রেমিকের সঙ্গে পালান। আশ্রয় নেন প্রেমিকের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে তাদের বিয়ের বিষয়ে আলাপ হওয়ার পর সেই মেয়েটির পরিবারকে জানানো হয়। মেয়েটির পরিবার বিষয়টি মীমাংসা করতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সে সময় মেয়েটিকে বলা হয়েছিল তার প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্যই তাদের ইউপি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরে কূটকৌশল করে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নিজেই মেয়েটিকে বিয়ে করেন। নিজের প্রেমিকার অন্য কারও সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাওয়ার ঘটনায় ওই তরুণ আত্মহত্যার চেষ্টা করে। পরে চেয়ারম্যানকে তালাক দেয়ার পর আবারও প্রেমিকের বাড়ি ফিরে যান ওই মেয়েটি।
অনেক এলাকার স্থানীয় মাতব্বররা ক্ষমতাসীন ও জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশে অসাধু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এলাকায় মিথ্যা অভিযোগ তুলে বিভিন্ন মানুষকে সালিশের নামে হয়রানি করেন। অর্থলোভে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে বিভিন্নজনকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করেন। এতে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে বিব্রতকর অবস্থায় সম্মুখীন হন ভুক্তভোগীরা। আবার সালিশের রায় মেনে না নিলে সামাজিকভাবে একঘরে করে রাখার মতো সিদ্ধান্ত ও হুমকিও দেন কথিত সালিশদাররা। অধিকাংশ সালিশেই প্রভাবশালী পক্ষ দুর্বল পক্ষের ওপর জোর করে মতামত চাপিয়ে দেয়।
সালিশ বা গ্রাম্য আদালতের ক্ষেত্রে বিচারনির্ভর করে বাদী-বিবাদী কোনো দলের রাজনীতি করেন, সেটির ওপর। ধর্ষণের মতো ঘটনাও নেয়া হয় ভিন্ন খাতে, ধামাচাপা দেয়া হয় ফৌজদারি অপরাধও। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিরীহ সাধারণ মানুষ। ন্যায়বিচার না পেয়ে গ্রাম আদালতবিমুখ হন বিচারপ্রার্থীরা। যার ফলে, বাদী-বিবাদীরা হয়রানির শিকার ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তুচ্ছ ও ছোট ঘটনাতেও মামলা করা হচ্ছে। এতে আদালতে বাড়ছে মামলাজট।
আদালতে মামলার চাপ কমানো ও গ্রামীণ জনপদের মানুষের ন্যায়বিচারের দ্রুত পাওয়ার জন্য ২০০৬ সালে আইন করে দেশে গ্রাম আদালত চালু করে সরকার। কিন্তু পক্ষপাতিত্ব বিচারের কারণে গ্রাম আদালতের প্রতি আস্থা হারিয়ে জনগণ। তদারকির অভাবে আদালতগুলো ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম গ্রাম আদালতও রয়েছে। ছোট-ছোট অনেক ঘটনাতে মানুষ সুফল পাচ্ছেন। সম্প্র?তি গ্রাম আদালত সক্রিয় করতে বাংলাদেশকে অর্থ সহায়তা করবে বলে জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
ন্যায়বিচার করলে গ্রাম আদালতের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে। ছোটখাটো বিরোধ মেটাতে গ্রাম আদালত কার্যকর ভূমিকা পালন এবং নিষ্ক্রিয় আদালতগুলো পুরোপুরি সক্রিয় করতে পারলে মামলাজট কিছুটা হলেও কমবে এবং দুর্ভোগ থেকে রেহাই পাবে সাধারণ মানুষ। তবে গ্রাম আদালতের সিদ্ধান্তগুলো নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত হচ্ছে কি না, তার তদারকি থাকতে হবে। তাহলেই কেবল ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যেতে পারে।
কানাইখালী, নাটোর